বালি অ্যাথলেটিক ক্লাব |
ঐতিহ্যের দৌড় |
শান্তনু ঘোষ |
১৮৮৮। বালির বাসিন্দা বছর কুড়ির এক যুবক ঠিক করলেন সাহেবদের সঙ্গে ফুটবলে পাল্লা দেবেন। কলকাতার কলেজে পড়ার সুবাদে খেলাটাও বেশ রপ্তও করেছিলেন তিনি। কিন্তু দরকার ছিল একটি দল তৈরি করার। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। পাড়ার কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে বালি স্কুল মাঠে শুরু করলেন খেলাধুলো। জন্ম নিল ‘বালি ওয়েলিংটন ক্লাব’। ওই যুবক মনোমোহন গোস্বামী।
সেই ক্লাবই আজকের ‘বালি অ্যাথলেটিক ক্লাব’। পায়ে পায়ে ১২৪ বছর পার করে ১২৫-এ ফেলল এই ক্লাব। এই উপলক্ষে আট-আশি সদস্যদের নিয়ে পদযাত্রার মধ্যে দিয়ে হয়ে গেল ‘একশো পঁচিশ’ বছরের উৎসবও। গঙ্গার পাড় ঘেঁষে জিটি রোডের ধারে বিশাল সবুজ মাঠের এক ধারে বালির শতাব্দী প্রাচীন এই ক্লাবের শিবির। ১৯৬৭-তে বালি পুরসভার তৎকালীন প্রশাসক এস এন দাস এবং সদস্য, শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল এই শিবির। এক সময় বাইচ, হকি, ক্রিকেট খেলা হত। মনমোহনবাবু ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও সব ধরনের খেলারই ব্যবস্থা করেন। অন্য সব কিছু বন্ধ হয়ে গেলেও আজও চালু আছে টেবলটেনিস। |
|
ক্লাবের প্রবীণ সদস্যেরা জানালেন, মনোমোহনবাবুর পরে ক্লাবের দায়িত্ব নেন শশাঙ্কশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রনাথ শেঠ, লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর মতো তাঁর কয়েক জন সহযোগী। তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে অন্যান্য খেলার পাশাপাশি চলল ফুটবল প্রশিক্ষণ। তার পরে এল ১৯১১ সালে মোহনবাগান ক্লাবের আই এফ এ শিল্ড জয় করে ‘ইস্ট ইয়র্ক’ দলকে হারিয়ে। এই জয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯১২-তে হুগলির উত্তরপাড়ায় দলকে হারিয়ে। এই জয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯১২-তে হুগলির উত্তরপাড়ায় আয়োজিত ভাওয়েল কাপের ফাইনালে কলকাতার তৎকালীন নামী মিলিটারি দল ‘রয়্যাল আর্টিলারি গ্যারিসন’কে ৩-১ গোলে হারিয়ে নজির সৃষ্টি করে এই ক্লাব।
এক সময়ে বালির এই ক্লাবের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হত ডানকান কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। খেলে গিয়েছেন শৈলেন মান্না, সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ রায়, কাইজার-সহ অনেক নামী খেলোয়াড়। প্রবীণদের আড্ডায় বারে বারে ফিরে আসে রাধানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। লোকে চিনতেন ‘রাজা’ নামে। এক সময় তিনি ক্লাব পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। ১৯২৯-এ ভবানীপুর মাঠে হাওড়া ইউনিয়ন-এর হয়ে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলার সময় গুরুতর আহত হয়ে মারা যান রাজাবাবু। তাঁর স্মৃতিতে এক সময় আইএফএ-র পরিচালনায় ‘রাজা শিল্ড’ খেলা হত। |
|
১৯২৯-এই ক্লাবে আসেন কার্তিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি সম্পর্কে সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দাদু। দীর্ঘ দিন ক্লাবের কর্ণধার ছিলেন কার্তিকবাবু। শুধু ক্লাব পরিচালনাই নয়, নিজেও ফুটবল খেলতেন। ১৯২৬ থেকে নিয়মিত ভাবে হাওড়া ইউনিয়নের হয়ে খেলতেন তিনি। তাঁর সময়ে টানা ১৪-১৫ বছর ধরে মফস্সলের ফুটবল প্রতিযোগিতায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছিল এই ক্লাব। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ক্লাবের প্রবীণ সদস্য ৯২ বছরের সিদ্ধেশ্বর বিশ্বাস। এক সময় তিনিও ফুটবল খেলতেন। পুরনো ছবিতে হাত বোলাতে বোলাতে সিদ্ধেশ্বরবাবু বলতে থাকেন, “আমাদের ক্লাব তো সূতিকাগার। এখান থেকেই তো তৈরি হত খেলোয়াড়। পরে যারা কলকাতা কাঁপিয়েছিল।” কার্তিকবাবুর মৃত্যুর পরে ১৯৯৪-এ তাঁর নামে ফুটবল কোচিং শুরু হয়। সেখানে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়রা। এখন ১৫ জন খেলোয়াড়কে নিয়ে গোলকিপিংয়ের প্রশিক্ষণ দেন দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। |
|
জিটি রোড থেকে বালি স্কুল মাঠে ঢুকতেই মূল গেটের পাশে চোখে পড়বে পায়ে বল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মূর্তি। শচীন্দ্রনাথ মিত্র। যদিও ফুটবল জগত তাঁকে চেনে ‘ল্যাংচা মিত্র’ নামেই। রাজাবাবুর সময়ে বালির এই ক্লাবের হয়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই চলে যান হাওড়া ইউনিয়নে। তার পরে জর্জ টেলিগ্রাফ, ভবানীপুর হয়ে ১৯৩৯-এ মোহনবাগান। সে বছরই প্রথম মোহনবাগান আইএফএ লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। তখন মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন এই ক্লাবেরই আর এক প্রাক্তনী বিমল মুখোপাধ্যায়।
এ ক্লাবের ইতিহাসে আরও একটি উজ্বল নাম বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৬-তে রোম অলিম্পিকে ভারতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন। তার আগেই ১৯৫৪-এ ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’-এর নাম বদলে হয় ‘বালি অ্যাথলেটিক ক্লাব’। |
|
আছে আরও নানা কীর্তি। ১৯৩৭-’৩৮ সালে ফুটবল এবং অ্যাথলেটিক্সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার ১৯৭৫-’৭৬-এ কেরলে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতায় অ্যাথলেটিক্সে বাংলা দলের যুগ্ম প্রশিক্ষক হয়েছিলেন এ ক্লাবের সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪০-’৪১ সালে শুরু হয়ে ১৯৫৮ পর্যন্ত এখানে হকির চর্চা হত। হকিতেও সাফল্য এসেছিল। ১২৫-এর ট্যাবলোতে অসংখ্য পুরনো ছবির সঙ্গে সে ছবিও জায়গা করে নিয়েছে।
১২৫ বছরের এই পরিক্রমায় হাওড়ার খেলাধুলোর জগতে ঠিক যে ভাবে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে বালি অ্যাথলেটিক ক্লাব!
|
|
|
বালি স্কুল মাঠের পাশেই ছিল রিভার টমসন সাহেবের স্কুল। সেখানে পড়াশোনার সুবাদে ১৯৩৮ সালে বালি অ্যাথলেটিক ক্লাবে খেলাধুলোয় যোগ দিলাম। কার্তিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সব খেলোয়াড়দের অসম্ভব গাইড করতেন। গোলকিপার ছিলাম। কিন্তু ১৯৬৯-এ প্রতিরক্ষা দফতরে চাকরি পেয়ে ক্লাবের হয়ে খেলাটা ছাড়তে হল। তবে, অফিসের হয়ে খেলতাম। আজ সেই ক্লাবের ১২৫ বছরে থাকতে পেরে গর্ববোধ করছি।
সিদ্ধেশ্বর বিশ্বাস (৯২), ক্লাব সদস্য |
|
|
বাবা গজেন্দ্রনাথ ঘোষ দীর্ঘ দিন ওয়েলিংটন ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। আমিও তাই। শরীর না চললেও ক্লাব ছাড়ে না। সাত-আট বছর বয়সে রিভার টমসন সাহেবের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বালি অ্যাথলেটিক ক্লাবে যাতায়াত শুরু। তখন অবশ্য এখনকার মতো কোচ ছিল না। সিনিয়রদের অনুকরণ করেই খেলা শিখতাম। তবে কার্তিকদাকে গুরু বলি। কেননা, সব বিষয়ে গাইড করতেন ওই মানুষটি। তবে খারাপ লাগে, ক্লাবের খেলায় ক্লাবেরই অনেক ছেলেকে বড় একটা অংশ নিতে দেখা যায় না। কিন্তু ল্যাংচা মিত্রকেও দেখেছি সব ছেড়ে ক্লাবের হয়ে খেলতে।
দিলীপ ঘোষ (৮৯), ক্লাব সভাপতি |
|
|
রিভার টমসন সাহেবের স্কুলে পড়তাম। সেই সূত্রেই বালি স্কুল মাঠে খেলাধুলো। সেই থেকে বালি অ্যাথলেটিক ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে পরি। নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ল্যাংচা মিত্রের কাছে খেলা শিখেছি। আমাদের তিন পুরুষ এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। বাবা শশাঙ্কশেখর ও পাড়ারই রাজেন শেঠ এক সময় ক্লাবের কর্মকর্তা ছিলেন। দাদাও খেলতে গিয়ে মারা যান। ক্লাবের প্রশিক্ষক ও খেলোয়াড়দের মধ্যে আত্মিক বন্ধন ছিল। তাই বোধ হয় তখনকার দিনে এক ঝাঁক তরুণ খেলোয়াড় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দাপিয়েছেন।
সমর বন্দ্যোপাধ্যায় (বদ্রু), প্রাক্তন ফুটবলার |
|
|
আমার বাবা, ঠাকুরদা বালি অ্যাথলেটিক ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার এক দাদা রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুটবল খেলতে গিয়ে মারা যান। আমিও ছোট থেকে এই ক্লাবে খেলা শিখে কলকাতার মাঠে বহু খেলেছি। এই ক্লাব আমার প্রাণ।
সৌরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন ফুটবলার |
|
|
এই ক্লাবের সঙ্গে আমার আত্মিক যোগ রয়েছে। ক্লাবের সুখ-দুঃখ সব কিছুই আমার রক্তে মিশে রয়েছে। ক্লাবের আন্তরিকতা, ভালবাসা শুধু আমাকে নয়, বালির প্রতিটি মানুষকেই ছুঁয়ে যায় বা গিয়েছে বলে মনে করি।
সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন ফুটবলার |
|
|
১১-১২ বছর বয়সে এই ক্লাবে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। সত্যজিৎদা’র হাতেই ফুটবলের হাতেখড়ি। এ ছাড়াও আরও কয়েক জন ছিলেন যাঁরা আজ আমার এই সাফল্যের পিছনে। ফুটবলের জন্য এমন আদর্শ পরিবেশ আমি জীবনে দেখিনি।
অর্ণব দাশশর্মা, গোলকিপার, মহমেডান স্পোর্টিং |
|
|
বছর পাঁচেক আগে সত্যজিৎদা’র কথায় এই ক্লাবের হয়ে বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলেছি। অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি। আজও সত্যজিৎদাকে সম্মান করি।
সত্যব্রত ভৌমিক, কোচ, চিরাগ-টালিগঞ্জ ক্লাব |
|
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার |
|