|
|
|
|
|
|
|
মনোরঞ্জন... |
|
বহু প্রেম করবেন বিয়ে একটাই |
কেমন হবেন নতুন রবিশঙ্কর। যদি জন্মান এই ২০১২-য়!
অনুমান করার চেষ্টায় শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
বিভাগীয় সম্পাদক মশাই এবার একটা অপূর্বপ্রায় অলৌকিকসমস্যা আমার দিকে ছুড়ে দিয়েছেন, যার সমাধান চোখ বন্ধ রেখে রুবিক্স কিউব মেলানোর মতো মুশকিলের। জানতে চেয়েছেন রবিশঙ্কর যদি ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল না জন্মে ২০১২-র ওই তারিখে জন্মাতেন তো কী হত, কী হতেন ইত্যাদি। তো আগেই বলে নিই যে, আমার পদবিতে ভট্টাচার্য থাকলেও আমি জ্যোতিষ সম্রাট রমেশ ভট্টাচার্যের তিন কুলের কেউ নই। পরের দিন কী ঘটতে চলেছে তাও ঠাওরাতে পারিনি কোনও দিন। তবু ভাবছি...
এমন একটা প্রসঙ্গে দুটো কথা মনে আসছে। প্রথমটা সেন্ট অগাস্টিন সংক্রান্ত, যাঁকে সেন্ট পল-এর পর খ্রিষ্টধর্মের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। তো প্রথম সহস্রাব্দের শেষের আগের দিন, মানে ৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁকে দেখা গেল নিশ্চিন্তে মঠের বাগানে ঘাস কাটছেন। তো এক তরুণ পাদ্রি সন্তকে জিজ্ঞেস করল, ‘পিতঃ, শোনা যাচ্ছে কাল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমনটাই নাকি ভবিষ্যদ্বাণী। তো আপনি কী করবেন?’ অগাস্টিন মাথা না তুলে, ঘাস কাটতে কাটতে উত্তর দিলেন, ‘আজ এখন যা করছি ঠিক সেটাই করব।’ |
|
দ্বিতীয় কথাটা দরবারি কানাড়া রাগের স্রষ্টা মিঞা তানসেনকে নিয়ে। আকবর বাদশাহের সভারত্ন তিনি যখন দরবারি নির্মাণ করলেন মেঘ ও মালকোষ মিলিয়ে, তখনকার শাহি দরবারের খ্যাতি ও ক্ষমতা আজকের দিনের রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতো। তখন কি সুরসম্রাট একবারও ভেবেছিলেন কী হবে রাগটার যখন দরবার বলেই কোনও বস্তু থাকবে না সংসারে? অথচ ভাবুন, দরবার-টরবার চুলোয় গেলেও দরবারি কিন্তু অসংখ্য গানে, নানা কন্ঠে, নানা যন্ত্রে রমরমিয়ে টিকে আছে। এমনকী, বছর পঞ্চাশ আগে এক সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ যখন জিজ্ঞেস করলেন ভারতের এক সর্বকালের সেরা সঙ্গীতগুণী উস্তাদ হফিজ আলি খান সাহেবকে, ‘উস্তাদজি, আপনার জন্য সরকার কি কিছু করতে পারে?’ তিনি উত্তর করেছিলেন, ‘দেখুন সাহেব আজকাল গাইয়ে-বাজিয়েরা দরবারি রাগের চেহারা ঠিক বজায় রাখছে না। দরবারির শুদ্ধতা ধরে রাখার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।’
২০১২-তে জন্মালেও রবিশঙ্কর রবিশঙ্কর না হয়ে পারতেন না। তিনি সদ্যপ্রয়াত পণ্ডিত রবিশঙ্করের ভাবশিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার সমস্ত রেকর্ড শুনে শুনে ভাবের তালিম নিতেন। এই শতাব্দীতে রাগের শুদ্ধতা কিন্তু আরও বড় সমস্যা হবে আগামী যন্ত্রীদের কাছে। নব রবিশঙ্করের নাড়ির জ্ঞান থাকবে যে, সবচেয়ে বড় সৃষ্টিশীলতা হল আদি, অকৃত্রিম জিনিসকে ঠিক আগের মতো করে ধরে রাখা। ২০১২-তে জন্মে রবিশঙ্করের পক্ষে সেটা সহস্রগুণ কঠিন হবে।
রবিশঙ্কর তাঁর গুরু আলাউদ্দিন খান সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন যে, বাবা এত এত ঘরের বিদ্যা, এত এত যন্ত্রের কৌশল, খুঁটিনাটি রপ্ত করেছিলেন যে ওঁর ওই একার মধ্যেই সঙ্গীতের অফুরান রূপ আমরা পেয়ে গেলাম। নানা ঘরের আলাপ ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল ছাড়াও রবাব বীণা সুরশৃঙ্গার সরোদ বেহালা তবলা ক্ল্যারিনেট বাঁশি জলতরঙ্গকী নয়। কালে কালে রবিশঙ্কর নিজেও এমন একটা সহস্রবিদ্যার আকর হয়েছিলেন যে শুধু প্রিয় এক শাস্ত্র সিনেমার রূপরসকলার নাড়িনক্ষত্র মেনে এবং নিজের হাতে একটা ফিল্ম তোলার চরম অভিলাষ থাকা সত্ত্বেও শেষ অব্দি একটা ছবি শেষ করে উঠতে পারেননি। ২০১২-র রবিশঙ্কর হার্গিস একটা ছবি করতেন। আর সে-ছবি কোনও অপেরা গোছের ছবি হত না। ‘ঘনশ্যাম’ শীর্ষক এক বিফল অপেরা করে খুব শিক্ষা হয়েছিল ওঁর। নব রবিশঙ্করের ছবি হত নারী-পুুরুষের সম্পর্কের আলো-আঁধারি নিয়ে বার্গম্যানের ছবির ধারায়। বার্গম্যান নিয়ে বলতে গিয়ে যে আহ্লাদ ওঁর কথায় প্রকাশ পেতে দেখেছি তা অবিশ্বাস্য। বার্গম্যানকে বলেছেন সিনেমার অবতার। বার্গম্যানের মতোই নারীর প্রেম ও যৌনতা ওঁকে মুগ্ধ করত। এ ছাড়া বুনুয়েল-এর ‘ফাম দু জুর’ ছবির নায়িকা কাতরিন দনোভ-এর চেহারা চরিত্র অভিনয়ের প্রতি খুব আকৃষ্ট বোধ করতেন। নব রবিশঙ্কর তো আর দনোভ বা লিভ উলম্যান পাবেন না, তবে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পর যাকেই পাবেন তাকেই ওই আদলে গড়ে নেবেন। |
স্ত্রী সুকন্যা |
যৌবনে অন্নপূর্ণার সঙ্গে |
|
ব্রিটিশ রাজপরিবারে যে-হারে মুক্ত হাওয়া বইছে তাতে প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্সেস কেট-এর সম্ভাব্য কন্যাসন্তান কি সিনেমায় আসবেন? তাহলে রবিশঙ্কর ২-এর নায়িকা হয়তো সেই। নাকি অমিতাভ বচ্চনের নাতনি আরাধ্যা? ঈশ্বর জানেন। তবে যেই হন, রবিশঙ্করের ছবির নামটা আঁচ করতে পারছি। রবিশঙ্করের প্রথম অবতারে সৃষ্ট রাগের নামানুসারে‘রসিয়া’। তবে ছবির থিম সুর হিসাবে বাজবে রসিয়া, বাঁশি বা সেতারে নয়, খুব একটা প্রাচীন যন্ত্রেইপিয়ানোয়। মনে আছে কী ভীষণ শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ ছিল এই যন্ত্রটির প্রতি রবিশঙ্করের। একদিন সারা সকাল-দুপুর ‘রাগ-অনুরাগ’-এর কাজ সেরে ভদ্রলোক বেরিয়েছিলেন সঙ্গিনী কমলাকে নিয়ে বৃদ্ধ আর্টর রুবিনস্টাইনের পিয়ানো কনসার্ট শুনতে। আর তার পরদিন পুরো একটা ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেন সেই পিয়ানো আসরের নাড়িনক্ষত্র নিয়ে আলোচনায়। তাই মনে হয়, নতুন অবতারে রবিশঙ্কর সেতারের পাশাপাশি পিয়ানো চর্চাও করবেন।
তবে খুব সম্ভবত ২০১২-র রবিশঙ্কর ১৯২০-র রবিশঙ্করের জীবনের সব ভুল আনন্দের সঙ্গে পুনরাবৃত্ত করবেন, শুধু একটি ভুল ছাড়া। তিনি একটির বেশি বিয়ে করবেন না। মুখে অনেক দুঃখ-অভিমানের কথা বললেও, এমনকী রাগেরও, তিনি অন্নপূর্ণার একটিও স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। ওঁর মুখচোখের দিকে চোখ ফেললেই আমি বুঝে ফেলতে পারতাম। অফ দ্য রেকর্ড কত যে কথা শুনেছি, প্রবল অভিমানের সঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন সেই সব ধারণার, যে তিনি নাকি স্ত্রীকে শপথ করিয়েছিলেন দেবীমূর্তির সামনে যে, তিনি কখনও জনসমক্ষে বাজাবেন না। আর স্ত্রীর বাসনা সম্পর্কে যে কী গভীর সমীহ ছিল তা আমি ভালই জানি। তাই মনে হয় নব রবিশঙ্কর একটাই বিবাহ করলেও সেই স্ত্রী সঙ্গীতজ্ঞ হবেন না। আর দ্বিতীয় বিয়ে করে যে ভাবে তিনি বন্ধুবান্ধব, সঙ্গীসাথি, ভক্তসমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মর্মপীড়ায় ভুগেছেন তাতে অমন কাজটি আর কখনও করবেন না। নব রবিশঙ্কর নারীবিলাস থেকে অব্যাহতি নেবেন না, তবে সব সম্পর্কই হবে খুবই ক্ষণিকের।
নতুন রবিশঙ্করের সবচেয়ে মর্মান্তিক সমস্যা হবে যে ওঁর মাথার উপর কোনও বাবা আলাউদ্দিন বা দাদা উদয়শঙ্কর থাকবেন না, পাশে আলি আকবর, বিলায়েত খান বা সত্যজিৎ রায় থাকবেন না। নিজেকে মাপার মতো প্রতিভা বা ব্যক্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে তিনি পূর্বজন্মের মানুষটির মতো অত বিনয়ী হবেন না। নিজের প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর তিনি এ আর রহমানের কাজটাজের তোয়াক্কাই করবেন না। সিনেমা বা নাটকের সুরে তিনি পাশ্চাত্যের হেভি মেটাল ও প্রাচ্যের লোকগান মিলিয়ে এক নতুন সুরের ভাষা তৈরি করবেন। তিনি জোহান সেবেস্টিয়ান বাখের ফিউগ ও ভারতের পুরিয়া মিশিয়ে ‘পুরিয়া বাখ ’ কম্পোজ করবেন। তিনি নিজের মেধায় মোৎজার্টের ‘ম্যারেজ অফ ফিগারো’ অপেরা স্টেজ করবেন এবং ফিগারোর অভিনয় করবেন। তিনি নিজে লিখে একটা অপেরা করবেন। বিট্ল, জন লেননকে নায়ক করে। একটা সিম্ফনি রচনা করবেন যার বিষয় ও নাম হবে ‘কাশী’ নতুন রবিশঙ্করের চেষ্টা হবে পুরোনো রবিশঙ্করের রেকর্ডবদ্ধ সব কাজের তামিল নিয়ে শেষ অবধি পুরোনো জনকে পেরিয়ে যাওয়া হারিয়ে দেওয়া। যা তিনি কিছুতেই পারবেন না। এমন একটা ভূত হয়ে সারাক্ষণ চেপে বসে থাকবেন পূর্বজন যে নব রবিশঙ্কর পঞ্চাশ পেরিয়ে ক্রমশ হতাশাগ্রস্ত হতে থাকবেন। অনেকটা মোৎজার্টের প্রতিভার তাড়নায় উন্মাদ অ্যান্তোনিও স্যালিয়েরির মতো। যে করুণ দ্বন্দ্ব নিয়ে বিশ্রুত নাটক ও সিনেমা ‘আমাডেয়স’। বলা বাহুল্য এমনতর হতাশায় পড়ে নব রবিশঙ্কর খুব দীর্ঘজীবী হবেন না। প্রথম জন ফরাসি নারী, ফরাসি সুগন্ধি আর কনিয়াকের ভক্ত ছিলেন। যদিও বছরে মাত্র দু’ চারবারই কনিয়াক ছোঁয়াতেন ঠোঁটে। দ্বিতীয় জনও ফরাসি নারী ও সুগন্ধিতে বশ থাকবেন। কিন্তু পানীয় বাছবেন সুইডিশ ভডকা, যা হতাশার মুহূর্তে ওঁর আশ্রয় হবে। স্বামীজি জীবনপ্রান্তে এসে কাশ্মীরে সিস্টার নিবেদিতার কাছে আক্ষেপ করেছিলেন “এই বিবেকানন্দ কী ছিল তা জানতে আর একটা বিবেকানন্দের প্রয়োজন হবে।” অতখানি গুরুত্বের সঙ্গে না হলেও পণ্ডিত রবিশঙ্করও বলে যেতে পারতেন যে রবিশঙ্করের কীর্তির তল পেতে আর এক রবিশঙ্করের দরকার হবে। তাতে দ্বিতীয় রবিশঙ্করের কী দশা হতে পারে সেটাই দুর্ভাবনার। |
কন্যা অনুষ্কা |
নোরা ও অনুষ্কা |
|
দ্বিতীয় রবিশঙ্করের যৌবনকালে পাশ্চাত্য পপ প্রবল ডামাডোলে হিন্দি সিনেমার গান উচ্ছন্নে গিয়েছে। নতুন করে ফিরে আসছেন মাইকেল জ্যাকসন, এলভিস প্রেসলি, জন ডেনভার, ব্রুস স্প্রিংগন্টিন, এল্টন জন। মেয়েদের মধ্যে জোন কলিন্স, হুইটনি হিউস্টন, সারা ব্রাইটম্যান। ভারতীয় গানে স্থায়ী আসন পেয়েছেন লতা, রফি, হেমন্ত, মান্না, আশা, মুকেশ, গীতা। অমর হয়েছেন রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিলায়েত, আমজাদ আলি খান। দেবত্বে আরোহণ করেছেন আমির খান, গোলাম আলি খান, ভীমসেন। নতুন রবিশঙ্কর টের পাচ্ছেন শুধু আওয়াজ দিয়ে বশ হওয়ার নয় পাবলিক, তাঁরা চাইছে শাস্ত্র, নতুন প্রজন্ম যন্ত্রের বোতাম টিপেই পেতে চাইছে অমৃত। কাজেই তিনি বারো ঘণ্টা রেওয়াজে সঁপেছেন নিজেকে। হঠাৎ করে একটা নতুন ধুম হয়েছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের, সবাই বলছে ক্ল্যাসিক্যাল ইজ দ্য লেটেস্ট পপ।
যা যা ভাবতে পারলাম তা এটা ধরে নিয়েই যে প্রথম রবিশঙ্কর ইতিহাসে আছেন, দ্বিতীয় জন নতুন অবতার। কিন্তু যদি মনে করি যে প্রথম জনই প্রথম জন্মালেন ২০১২-য়? সে যে কি ভীষণ এক পরিস্থিতি হবে তা চিন্তার অতীত। ২০১২-র রবিশঙ্করকে সেক্ষেত্রে কেচে গণ্ডূষ করে যাত্রা করতে হবে। নতুন করে চাকা আবিষ্কারের মতো। ভারতীয় সঙ্গীত রবিশঙ্করহীন ভাবাটা শিবহীন বারাণসী কল্পনা করার মতো। বা ডেনমার্কের রাজকুমারহীন ‘হ্যামলেট’ নাটক। |
|
|
|
|
|