গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর উপর্যুপরি বিজয় যতটা প্রত্যাশিত ছিল, হিমাচল প্রদেশে বিজেপির পরাজয় ততটাই অপ্রত্যাশিত। কংগ্রেস যে বিজেপির হাত হইতে এই রাজ্যটি ছিনাইয়া লইতে পারিয়াছে, তাহার কারণ প্রাদেশিক নেতা বীরভদ্র সিংহের উপর শেষ মুহূর্তে দলের সম্যক নির্ভরতা। পাঁচ বার লোকসভার সাংসদ, সাত বার বিধায়ক এবং পাঁচ বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া বীরভদ্র সিংহই হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেসের সর্বাপেক্ষা দীর্ঘকায় রাজনীতিক। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হইতে নির্বাসিত হন বটে, কিন্তু হিমাচলে তাঁহার জনপ্রিয়তা ও গণভিত্তিই কংগ্রেসকে জয়ী করিয়াছে। প্রাদেশিক নেতা বা আঞ্চলিক মনসবদারদের উপর নির্ভর করার ফল দল হাতেনাতে পাইয়াছে। গুজরাতে কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর মহড়া লওয়ার মতো কোনও প্রভাবশালী প্রাদেশিক নেতা কংগ্রেস গড়িয়া তুলিতে পারে নাই। তাই সনিয়া কিংবা রাহুল গাঁধীর সফর ও নির্বাচনী প্রচার শেষ পর্যন্ত জনাদেশে কোনও ইতিবাচক প্রভাবই ফেলিতে পারে নাই।
‘পরিবার’-এর দাপট বিজেপিতেও সমস্যা। গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর সাফল্যের পিছনে সঙ্ঘ পরিবারের কোনও ভূমিকা নাই। বরং পরিবারকে কার্যত নিষ্ক্রিয় রাখিয়া মোদী একাই তাঁহার দুর্গ রক্ষা করিয়াছেন। বলিলে ভুল হইবে না, মোদীকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তেমন লড়াই করিতে হয় নাই, অনেক বেশি লড়িতে হইয়াছে নাগপুরের বিরুদ্ধে। তাঁহার আর্থিক কর্মসূচি, তাঁহার শিল্পনীতি, তাঁহার সংস্কারমুখিতা, সবই যে পরিবারের সনাতনপন্থার বিরোধী। পক্ষান্তরে, হিমাচল প্রদেশের মতো দুই একটি নিরুপায় ব্যতিক্রম বাদ দিলে, কংগ্রেস কিছুতেই নেহরু-গাঁধী পরিবার ও তাহার বশংবদ হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার সেই সাহস দেখায় নাই। রাজ্যে-রাজ্যে আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতাদের বিকাশ-বৃদ্ধি একান্ত ভাবেই হাইকমান্ডের মর্জিনির্ভর থাকিয়াছে। কোনও আঞ্চলিক নায়কের প্রভাব বর্ধমান মনে হইলেই তাঁহার কাছ হইতে চ্যালেঞ্জ আসার শঙ্কায় তাঁহার পক্ষ শাতন করা হইয়াছে। ফলে বিজেপিতে গুজরাতে মোদী, মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিংহ চহ্বাণ, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে, গোয়ায় মনোহর পারিক্কর, ছত্তীসগঢ়ে রমন সিংহের মতো স্থানীয় নায়করা উঠিয়া আসিয়াছেন, কংগ্রেসে কোনও প্রাদেশিক নেতাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হইতে দেখামাত্র অন্য কাহাকেও বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। গুজরাতে কখনও শংকরসিংহ বাগেলা, কখনও শক্তিসিংহ গোহিল, কখনও দীনশা পটেল, আবার কখনও ভরত সোলাঙ্কিকে তুলিয়া ধরা হয়। মধ্যপ্রদেশে দিগ্বিজয় সিংহের মতো পোড়-খাওয়া রাজনীতিককে হাইকমান্ডের তাঁবুতে বসাইয়া রাখিয়া সুরেশ পচৌরিকে চহ্বাণের মহড়া লইতে পাঠানো হয়। ছত্তীসগঢ়ে অজিত যোগীকে দিল্লিতে টানিয়া আনিয়া অনামা পছন্দের রাজনীতিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিণামে পরাভব হইলেও হাইকমান্ড তাহা হইতে কিছু শেখে নাই।
পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাইলেই বা আমরা কী দেখিতে পাই? বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের মতো এই রাজ্যেও কংগ্রেসের কোনও প্রাদেশিক নেতা বা নেত্রী নাই, যাঁহাকে রাজ্যবাসী শিরোধার্য করেন। একাধিক চণ্ডীমণ্ডপ স্তরের গ্রাম্য মোড়ল রহিয়াছেন, কিন্তু কেহই রাজ্যস্তরের নেতা নন। কখনও রাম, কখনও শ্যাম, কখনও যদু, আর ভোটের সময় পরিযায়ী পাখির মতো হেলিকপ্টার যোগে সনিয়া কিংবা রাহুল গাঁধীর রাজ্য-রাজনীতির মাটিতে অবতরণ, কয়েকটি সমাবেশ। এই প্রক্রিয়ায় কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। সে জন্য চাই রাজ্য স্তরের যথার্থ নেতা, যাঁহারা রাজ্যকে চেনেন, তাহার মানুষের হৃৎস্পন্দন অনুভব করেন এবং দিল্লির মুখাপেক্ষী না থাকিয়া সাহস ও কল্পনাশক্তি সহযোগে নির্দিষ্ট বাস্তবতার উপর দাঁড়াইয়া সিদ্ধান্ত লইতে পারেন। কিন্তু তাহা তো নেহরু-উত্তর কংগ্রেসের ধাতে নাই। ইন্দিরা গাঁধীর ইন্ডিকেট-এর জমানা হইতেই কংগ্রেস অতুল্য ঘোষদের খর্ব করিয়া আসিতেছে। তাই নরেন্দ্র মোদীর মতো প্রাদেশিক নেতার আবির্ভাব কংগ্রেসে কঠিন। সুতরাং কংগ্রেস সমর্থকদের অগত্যা রাহুল গাঁধীর হেলিকপ্টারের দিকেই চাহিয়া থাকিতে হইবে। |