তেহট্টে পুলিশের গুলি চালনার ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে দলীয় রাজনৈতিক মঞ্চ থেকেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৪ নভেম্বর তেহট্টের হাউলিয়া মোড়ে পুলিশের গুলিতে মৃত অশোক সেনের পরিবারের হাতে বৃহস্পতিবার তিনি দু’লক্ষ টাকার চেক তুলে দেন নদিয়া জেলা তৃণমূলের ডাকা সমাবেশ মঞ্চে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই সেখানে অশোকবাবু ছেলে অমিত সেনের হাতেও তুলে দেওয়া হয় হোমগার্ডের চাকরির নিয়োগপত্র। ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেওয়া হয় ওই ঘটনায় আহত সুধাময় ঘোষের হাতেও। ঘোষণা করেন, এই এলাকায় একাধিক প্রকল্পের কথাও। তারপর জনতার দিকে ফিরে বলেন, “কী কথা রাখলাম তো!”
বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “দলীয় মঞ্চ থেকে এ ভাবে চেক দেওয়া যায় না। যদি এটা হয়ে থাকে, রীতিনীতি বিরুদ্ধ কাজ হয়েছে। তবে এর আগে জেলা সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সরকারি মঞ্চকে দলীয় কাজে ব্যবহার করেছেন। এ বার দলীয় মঞ্চতে সরকারি কাজে ব্যবহার করলেন।” প্রশ্ন তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হয়েছে! চাইলে রাজ্য সরকার আর্থিক সাহায্য করতেই পারে। কিন্তু দলীয় মঞ্চ থেকে তা করা অনৈতিক। খুব খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হল। কারণ, সরকারি টাকা আসলে করদাতাদের টাকা।” তাঁর অভিযোগ, “আমরাও দলীয় মঞ্চ থেকে তেহট্টে গুলিচালনায় নিহতের পরিবারকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের ভয় দেখিয়ে আটকানো হয়েছিল।” |
মমতার এই দিনের জনসমাবেশের আয়োজন হয়েছিল ওই হাউলিয়া মোড় থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে তেহট্ট হাইস্কুল মাঠে। তিনি অবশ্য কৃষ্ণনগর থেকে সেখানে আসার পথে বেলা ১টা নাগাদ নেমে যান গলাকাটা কালীবাড়ির কাছেই। প্রশাসন সূত্রে খবর, রাস্তায় একটি বাস খারাপ হয়ে যাওয়ায় সভামঞ্চ থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার আগেই গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে হাঁটতে শুরু করেন মমতা। তেহট্টের মহকুমাশাসক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, “বাসটি সরানোর আগেই মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে পড়েন।”
ওই এলাকায় বেশ ঘন জনবসতি। তার মধ্যে দিয়েই মমতা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন, সে কথা দ্রুত ছড়িয়েও পড়ে। মমতাকে অবশ্য তখন পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীরা ঘিরে রেখেছিলেন। সেই বৃত্তের বাইরে ছিল দলীয় নেতাদের আর একটি বলয়। রাস্তার ধারেই রয়েছে একাধিক দোতলা, তিন তলা বাড়িও। তবে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি বলে দাবি করেছেন জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচী রমণ মিশ্র। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী নিজেই হঠাৎ হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা সে সময়ে যথাসম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলাম তাঁর জন্য। কোনও অসুবিধা শেষ পর্যন্ত হয়নি।”
মমতা এর মধ্যেই হঠাৎ ঢুকে যান রাস্তার ধারে এক ব্যক্তির বাড়ি। বাড়ির মালিক আমির হোসেন দফাদার তখন ছিলেন না। ছিলেন তাঁর স্ত্রী ফতেমা বিবি। ফতেমা বলেন, “বাঁশের চটার দরজা ঠেলে মুখ্যমন্ত্রী হনহনিয়ে ঢুকে পড়েন উঠোনে। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেই তিনি একটু জল খেতে চান।” এরপর আবার হাঁটতে হাঁটতে মমতা ঢুকে পড়েন হাউলিয়া মোড়ে।
এ দিন জনসভার মঞ্চে প্রশাসনের কর্তারা কেউ ছিলেন না। তাঁর বক্তৃতায় হাউলিয়া মোড়ের ঘটনাটি ‘অনভিপ্রেত’ ও ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন মমতা। তাঁর কথায়, “ওই ঘটনায় আপনারা যেমন খুশি নন, আমরাও তেমন খুশি নই।” ওই ঘটনায় আহত অখিলেশ ঘোষকে নগদ ২৫ হাজার টাকা দলের তরফে এবং সুধাময় ঘোষের হাতে সরকারের তরফে ২৫ হাজার টাকার চেক তুলে দেন তিনি। সুধাময়বাবুর স্ত্রী এবং অখিলেশবাবু ও অশোকবাবুর ছোট ছেলেকে চাকরি দেওয়ার কথাও তিনি ভাবছেন বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। বিভিন্ন জেলা সফরে তাঁর এক গুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণার চেনা রীতিও এ দিন বজায় রেখেছেন মমতা। গত অগস্টে এই জেলা সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই দিন সেগুলিই আবার ঘোষণা করেন। তবে তেহট্টের মানুষের জন্য কিছু নতুন আশ্বাস ছিল। এখানে একটি সেতু ও কলেজ গড়া হবে। তেহট্ট হাসপাতালে সাংসদ তহবিল থেকে হবে আইসিইউ। তৈরি করা হবে একটি পলিটেকনিক কলেজও। প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিটের বক্তব্য শেষে মঞ্চ থেকে নামার আগে মমতা বলে যান, “এটা তো রাজনৈতিক সভা, তাই বেশি বলছি না। পরের বার সব করে দেব।” |