নরেন্দ্র মোদীর হ্যাটট্রিক সম্পূর্ণ প্রত্যাশিত ছিল। কেন এই জয়, সেই প্রশ্নই মুখ্য। এবং, উত্তর লইয়া সংশয় নাই। গুজরাতের নাগরিকরা যেমন মুখ্যমন্ত্রী চাহেন, নরেন্দ্র মোদী ঠিক তেমন মুখ্যমন্ত্রী। একটি দেশের বা রাজ্যের মানুষ তাহার উপযুক্ত নেতাই পাইয়া থাকে এই কথাটি অনেক সময়েই নিন্দার্থে প্রযুক্ত হয়। মোদীর ক্ষেত্রে তেমন ব্যবহারের সুযোগ নাই, তাহা বলা যাইবে না। ২০০২ সালের গোধরা-উত্তর মুসলিম-নিধনের পৈশাচিক ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ দায়িত্ব না হোক, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রশাসনিক দায় তাঁহার উপরেই বর্তায়, কিন্তু গুজরাতের ভোটদাতারা দৃশ্যত সেই দায়কে যথেষ্ট গুরুভার বলিয়া মনে করেন না। কিন্তু গুজরাত রাজ্য এবং তাহার মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসনের এই পারস্পরিক সাযুজ্যটিকে নিছক সাম্প্রদায়িকতার ছকে দেখিলে খণ্ডদর্শন হইবে। মোদীর রাজনৈতিক সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা পালন করিয়াছে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পুরোহিত হিসাবে তাঁহার সাফল্য। দেশের খুব কম রাজ্যই মোদীর গুজরাতের মতো এমন ধারাবাহিক উন্নয়ন, বিপুল বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের কৃতিত্ব দেখাইতে পারিয়াছে। এমনকী মোদীর নিজের দল বিজেপি যখন বিরোধী রাজনীতির ক্ষুদ্রস্বার্থে খুচরা বিপণনে বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে সংসদের ভিতরে-বাহিরে আন্দোলনে নামিয়াছে, তখনও মোদী তাঁহার নির্বাচনী প্রচারে এই প্রশ্নে কোনও আপত্তি করেন নাই। অর্থনীতি এবং রাজ্যের স্বার্থ দলের স্বার্থকে অতিক্রম করিয়াছে। এবং রাজ্যের উন্নয়নকামী নাগরিকরা দুই হাত উজাড় করিয়া তাঁহার ভোটের বাক্স ভরিয়া দিয়াছেন।
এখানেই গুজরাতের মতো রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য। এখানেই পশ্চিমবঙ্গের সমাজের সঙ্গে তাহার চরিত্রগত তফাত। এই রাজ্য তিন দশক ধরিয়া বামফ্রন্টের জমানায় আর্থিক উন্নয়নের পথরোধকারী যাবতীয় নীতি ও কর্মসূচি আঁকড়াইয়া থাকিয়াছে। জ্যোতি বসুর অনন্য সাফল্যের পিছনে একটি বড় কারণ ছিল স্থিতাবস্থার প্রতি তাঁহার অনন্য আনুগত্য। তিনি উন্নয়নের কোনও চেষ্টাও করেন নাই। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে কার্যত অচল রাখিয়াই তিনি মহাকরণে অচল থাকিয়াছেন। বাম জমানার শেষ দিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অগ্রগতির চেষ্টা করিয়াছিলেন, অচিরে তাঁহাকে বিদায় লইতে হয়। পরিবর্তনের কান্ডারি রূপে যাঁহাকে রাজ্যবাসী ক্ষমতার গদিতে বসান, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্থিতাবস্থার নিরাপত্তাতেই বিশ্বাসী। তিনি দাঁড়াইয়া থাকিতেও চাহেন না, পিছনে হাঁটিতে চাহেন। জমি-অধিগ্রহণ, শহুরে জমির সিলিং শিথিল কিংবা শিল্পপ্রকল্পকে এসইজেড মর্যাদা দিবার বিরোধিতা করিয়া এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা নস্যাৎ করিয়া এই সরকার পশ্চিমবঙ্গকে অনুন্নয়নের বদ্ধ জলাতেই পরিণত করিতে আগ্রহী। এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই অচলাবস্থাকেই সমর্থন করিয়াছেন। সিঙ্গুর হইতে টাটা কোম্পানির নির্মীয়মাণ মোটরগাড়ি প্রকল্পকে ঢাকি-সুদ্ধ বিসর্জন দিয়া তৃণমূল নেত্রী শিল্পপতিদের যে বার্তা প্রেরণ করেন, তাহার মর্ম বুঝিয়াই নাগরিকরা তাঁহাকে ক্ষমতায় আনিয়াছেন।
নরেন্দ্র মোদী আপন রাজ্যে বৃহৎ শিল্পের জন্য জমির ব্যবস্থা করিতে অতি তৎপর থাকিয়াছেন। প্রকল্প-প্রস্তাব লইয়া আগুয়ান লগ্নিকারীদের কর-ছাড়, কম দামের জমি, ঋণ শোধের মেয়াদ সম্প্রসারণ ইত্যাদি সব রকম সুযোগসুবিধা মঞ্জুর করিয়া তাঁহাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করিতেও তাঁহার জুড়ি মেলা ভার। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতায় ফাইল আটকাইয়া থাকা, একশো রকমের অনুমতি আদায় ও দরখাস্তলিপি পূরণের বখেড়ায় জেরবার হওয়ার সম্ভাবনা দূর করিয়া মোদী ‘এক-জানালা পদ্ধতি’ মুখে নয়, কাজে চালু করিয়াও লগ্নিকারীদের আস্থাভাজন হইয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বাগাড়ম্বর করিয়াছে, রাজনীতিকরা অনেক আস্ফালন করিয়াছেন, দফায়-দফায় আলোচনাচক্র, সেমিনার, বৈঠক হইয়াছে। কিন্তু সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে লগ্নিকারীরা নিঃসংশয় হইতে পারেন নাই। তাহাতে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকদের কিছু যায়-আসে না। কারণ, রাজ্যের ভোটদাতারা লগ্নি চাহেন না, স্লোগান চাহেন। মা, মাটি এবং মানুষের স্লোগান। পশ্চিমবঙ্গ হইতে গুজরাত অনেক দূরবর্তী। |