জঙ্গলে বাঘের ভয়, ডাঙায় দুষ্কৃতীদের ভয়ও কম নয়। তার উপরে ঘূর্ণিঝড় আয়লায় এলাকা উজাড় হয়ে যাওয়ায় রুজির খোঁজে ভিন্-রাজ্যে চলে গিয়েছেন বাবা-মা। হিঙ্গলগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে বছর কুড়ির পিসতুতো দাদার ভরসায় বাঁচছে নাবালিকা চার বোন। রাতে বাঘের ডাকে কেঁপে উঠছে। সকালে সময় কাটে, বাঘের ভয়ে ঘরের সামনে-পিছনে গরান কাঠের যে বেড়া রয়েছে, তার ধারে দাঁড়িয়ে। কবে ফিরবে বাবা-মা, সেই অপেক্ষায়। এ রুটিন অবশ্য শুধু ষষ্ঠ শ্রেণির ঊষা গাইন আর তার তিন বোনের একান্ত নিজস্ব নয়। সুন্দরবনের জঙ্গল ঘেঁষা কালীতলা পঞ্চায়েতের তিন নম্বর সামসেরনগর গ্রামের আরও অনেক ছোট-ছোট মুখের।
সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে চলে গিয়েছে কুঁড়েখালি খাল। খালের পাড় দিয়ে সার-সার মাটির বাড়ি। কোনওটার চাল নেই। কোনওটা আবার পলিথিনের পাতলা চাদরে ঘেরা। এ রকমই একটা বাড়িতে সাত মেয়েকে নিয়ে বাস করতেন সুকুমার গাইন ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী। এক বিঘা একফসলি জমিতে ফসল ফলিয়ে এবং জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরে কোনও রকমে দিন কাটছিল। দু’মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। ২০০৮-এ আয়লা এল। সম্বল গেল। সংসার চালাতে ছোট মেয়ে সমাপ্তিকে সঙ্গে নিয়ে গাইন দম্পতি কাজের খোঁজে গিয়েছেন মহারাষ্ট্রে। বছর পুরতে গেল, তাঁদের দেখা নেই।
ঊষা এবং তার তিন বোনলক্ষ্মী, সরস্বতী এবং দেবযানী গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করে। তাদের ভরসা বলতে পিসতুতো দাদা বছর কুড়ির রমেশ গাইন। ভ্যান চালিয়ে কোনও রকমে মেয়েগুলোর দেখাশুনা করছেন ওই যুবক। রমেশ বলেন, “দিন-রাত খেটেও এমন আয় হয় না, যা দিয়ে পাঁচ জনের পেট চলবে। আয়লার পরে মাটিতে নুন বসে গিয়েছিল। নোনা এখনও না কাটায় ধান হয় না। আধ-পেটা খেয়ে চালাচ্ছি। অপেক্ষা করছি, মামাদের ফিরে আসার।” |
ঊষা বলল, “সপ্তাহে মাত্র দু’শো (মিলিলিটার) কেরোসিন মেলে। তা দিয়েই কোনও রকমে টেমি জ্বালিয়ে পড়াশুনা করি। রাতে আলো জ্বালাতে পারি না। ভয় আরও বাড়ে। এক-এক বার বাঘ ডাকে। বোনগুলো আমাকে জাপটে ধরে। ভয়ে ঘুম আসে না। কেবল বাবা-মা আর ছোট বোনটার কথা মনে পড়ে।” কালীতলা পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য নিতাইপদ রায় বলেন, “এলাকার বহু মানুষ কাজের খোঁজে বাইরে গিয়েছেন। জঙ্গলের বাঘ এবং ডাঙার বদমায়েশদের ভয়ে এলাকাবাসী কাঠ হয়ে থাকেন।”
এলাকায় আয়লার তাণ্ডবে তৈরি ঘা এখনও দগদগে। বাড়ি ধসে রয়েছে। চাষের জমিতে নুন বসে গিয়েছে। ভেসে গিয়েছে পুকুর, ঘেরির মাছ। প্রথম প্রথম যেটুকু সরকারি এবং বেসরকারি ত্রাণ এসেছিল, এখন তা বন্ধ। দুর্গতদের ঘর তৈরির তালিকা নিয়ে চলছে টালবাহানা। এলাকাবাসীর ক্ষোভ, ঘর কারা পাবেন তা নিয়ে হয়েছে রাজনীতি। দুর্গতেরা সরকারি টাকায় আরও কত দিন পরে ঘর তৈরি করতে পারবেন, সে নিশ্চয়তা নেই। এই পরিস্থিতিতে কালীতলা পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান দীপ্তি মণ্ডল মেনেছেন, “কাজের খোঁজে এলাকার (মোট বাসিন্দা প্রায় কুড়ি হাজার) চার হাজারের উপরে মানুষ অন্যত্র চলে গিয়েছেন।” প্রশাসন সূত্রের খবর, আয়লার পর থেকে ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দেওয়া হিঙ্গলগঞ্জের মানুষের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। কলকাতা, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, দিল্লির উদ্দেশে গিয়েছে এখানকার জনতা।
যোগেশগঞ্জ ট্রেকার স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেল, এলাকার অনেক মানুষকে গ্রাম ছাড়ার জন্য ট্রেকারের অপেক্ষায়। তাঁদের মধ্যে সামসেরনগরের গৌরপদ সর্দার, আরতি মণ্ডল বলেন, “গ্রামে কাজ নেই। বাচ্চাকে দেব কী, নিজেরা খাব কী? তাই কাজের খোঁজে যেতে হচ্ছে শহরে।” আয়লার ঝড় ও জলে তিন নম্বর সামসেরনগরের কালিন্দিপাড়া এবং আদিবাসীপাড়া প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। সেখানকার দশমী মুণ্ডা, সোহাগি সর্দারেরা বলেন, “বাড়িঘরের সঙ্গে জিনিসপত্রও ভেসে গিয়েছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গল থেকে জ্বালানির কাঠ আনতে হচ্ছে। দুষ্কৃতীদের উপদ্রব এবং বাঘের হামলা তো আছেই। পলিথিনের চাদরের তলায় অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়ে থাকার নিরাপত্তা নেই। বাধ্য হয়েই গ্রাম ছাড়ছি।”
বিডিও হিঙ্গলগঞ্জ বিশ্বজিৎ বসু দাবি করেছেন, এলাকার মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে দিয়ে প্রশিক্ষণ, স্বনিযুক্তি প্রকল্পের মহিলাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির, ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে মহিলাদের আরও বেশি সংখ্যায় যুক্ত করা, মিষ্টি জলের পুকুর কেটে মাছ চাষের সুবিধা করে দেওয়ার মতো কাজ প্রশাসন করছে। সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরার আশ্বাস, “কর্মসংস্থান, এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়ন-সহ নানা পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্য সরকারের। ধীরে ধীরে হবে।” তত দিন হয়তো প্রায় জনশূন্য গ্রামে রাতে বাঘের ডাকে কেঁপে ওঠা আর সকালে বাবা-মার প্রতীক্ষায় গরানের বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকাটাই ভবিতব্য ঊষাদের। |