যাত্রীদের চাপে পিছু হটল পুলিশ
নিত্যযাত্রীদের একাংশের গুন্ডামির কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করল আরপিএফ। মঙ্গলবার ভোরে কৃষ্ণনগর স্টেশনে ট্রেনে বেআইনিভাবে জায়গা রাখা রুখতে আরপিএফ ও জিআরপিকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালায় রেল। ধরা হয় দুই যাত্রীকেও। তারপরেই নিত্যযাত্রীদের একাংশ বিক্ষোভ দেখিয়ে ট্রেন আটকে দেয়। আন্দোলনকারীদের ‘চাপে’ শেষ পর্যন্ত ধৃত ওই দুই নিত্যযাত্রীকেও ছেড়ে দিতে হয়। এমনকী, তাদের গ্রেফতারি সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রকাশ্যে ছিঁড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর দশটা কুড়ি নাগাদ অবরোধ ওঠে। ভোগান্তির শিকার হন হাজার হাজার যাত্রী। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী বলেন, “এ বার থেকে নিয়মিতই অভিযান হবে। যাঁরা জায়গা দখল করে রাখছেন, ধরা পড়লে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হবে।” নিত্যযাত্রীদের এই ‘গুন্ডামি’তে ক্ষুব্ধ সাধারণ যাত্রীরা। তাঁরা আরপিএফের ভূমিকাকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ শর্মা যেমন অবরোধের কারণে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, “নিত্যযাত্রীরা আজ যা করলেন তা এক প্রকার গুন্ডামি। ট্রেনে ব্যাগ, দেশলাই, কাগজ, তাস রেখে জায়গা দখল করার বিষয়টি বৈধতা পেয়ে গেল।’’
কৃষ্ণনগর স্টেশনে চলছে অবরোধ। ছবি: সুদীপ ভট্টচার্য।
সকাল সাতটা পাঁচে কৃষ্ণনগর থেকে শিয়ালদহগামী লোকাল ট্রেনে নিত্যযাত্রীদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী ওই সব অভিযোগ সম্পর্কে রেলকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। তারপরেই রেল কর্তৃপক্ষ গত ১৫ দিন ধরে বিভিন্ন ট্রেনে আসন দখল করার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। টানা কুড়ি দিন এই ট্রেনটি ছাড়ার সময় রেল কতৃপক্ষের তরফে বেআইনিভাবে জায়গা দখল না করার জন্য মাইকে প্রচারও করা হয়। বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছিলেন আরপিএফ জওয়ানেরাও। মঙ্গলবার সকালে ট্রেন ছাড়ার আগে আরপিএফ জওয়ানরা বিশেষ অভিযান শুরু করেন। মালিকের খোঁজ না পাওয়ায় কয়েকটি ব্যাগ আটক করার পাশাপাশি দু’জন নিত্যযাত্রীকে জায়গা দখল করে রাখার অভিযোগে গ্রেফতার করে আরপিএফ। বিষয়টি জানাজানি হতেই মুহূর্তের মধ্যে বাকি নিত্যযাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে এসে জিআরপি থানার সামনে এবং দুই নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটির সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বিক্ষোভকারীরা ধৃতদের নিঃশর্ত মুক্তির পাশাপাশি আরপিএফ জওয়ানদের শাস্তি দাবি করেন। যাত্রীরা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভকারীদের কাছে ট্রেন ছাড়তে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। তবে নিত্যযাত্রীদের রুদ্র মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা প্রতিবাদের সাহস দেখাতে পারেননি।
নির্মলনগরের বাসিন্দা বিনয় মণ্ডল এসেছিলেন ওই ট্রেন ধরে শিয়ালদহ যাওয়ার জন্য। নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে বর্হিবিভাগে তাঁর চিকিৎসা চলছে। অসহায়ভাবে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, “প্রায়ই এই ট্রেন ধরে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যেতে হয়। আমি অসুস্থ, তা সত্ত্বেও নিত্যযাত্রীদের দাপটে বেশিরভাগ দিনই জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আজ তো যেতেই পারলাম না। চিকিৎসায় খুবই সমস্যা হবে।’’ সম্পর্কক্রান্তি এক্সপ্রেস ধরে দিল্লি যাবেন বলে তৎকাল টিকিট কেটেছিলেন পলাশির কাজলী সরকার ও তাঁর মেয়ে স্বপ্না। অবরোধে আটকে পড়ে সেই ট্রেনটাও ধরতে পারলেন না তাঁরা কাজলীদেবী বলেন,‘‘ সারারাত লাইনে দাঁড়িয়ে কোনওমতে টিকিট কাটতে পেরেছিলাম। অবরোধের জন্য ট্রেনটা পেলাম না, টিকিটের টাকাও ফেরত পাব না।’’ তিনি বলেন,‘‘ দিল্লিতে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি। চাকরিটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।’’ মঙ্গলবার সকাল থেকে এই ভাবেই হয়রানিতে পড়লেন যাত্রীরা। একটি লেডিজ স্পেশাল-সহ মোট তিনটি লোকাল ট্রেনকে বাদকুল্লা স্টেশন থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি আপ লালগোলা প্যাসেঞ্জার প্রায় আড়াই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে ওই স্টেশনে। এছাড়া শিয়ালদহগামী ডাউন লালগোলা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধুবুলিয়া স্টেশনে এবং ডাউন ভাগীরথী এক্সপ্রেস বেথুয়াডহরী স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেনগুলো প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘন্টা দেরিতে চলেছে বলে রেল সূত্রে জানা গিয়েছে। যাত্রীদের এই হয়রানিকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন নিত্যযাত্রীরা। ধৃতদের দাবি, তাঁরা মোটেও ব্যাগ রেখে অন্যের জন্য জায়গা দখল করেননি। ধৃত ধীমান ভট্টাচার্য বলেন,‘‘আমি নিত্যযাত্রী কিন্তু কারও জন্য জায়গা রাখিনি। নিজের জায়গায় ব্যাগ রেখে চা খেতে ট্রেন থেকে নেমেছিলাম। আরপিএফ আমাকে অহেতুক ধরে নিয়ে গেল আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে ব্যাগের ভিতর বিস্ফোরক বহন করার কেস দেবে বলে ভয় দেখিয়েছিল’’
বিক্ষোভকারী নিত্যযাত্রী দেবাশিস তলাপাত্র বলেন,‘‘ অনেক সময় নিত্যযাত্রীরা অন্যের জন্য জায়গা রাখেন ঠিকই। কিন্তু এ দিন যাদের আরপিএফ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁরা নির্দোষ আর সেই কারণেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সকলে। শুধু তাই নয় অহেতুক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে সাধারণ যাত্রীদেরও। দার্জিলিং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবশঙ্কর পালের বাড়ি কৃষ্ণনগরে তিনি কলকাতায় যাচ্ছিলেন। শিবশঙ্করবাবু বলেন, ‘‘ আমি আমার আসনে ব্যাগ রেখে প্লাটফর্মের শৌচাগারে গিয়েছিলাম। এসে দেখি ব্যাগ নেই আরপিএফ নিয়ে গিয়েছে। ব্যাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি কাগজপত্র ছিল। শেষে নিজের পরিচয় দিয়ে ব্যাগ ফেরত পেয়েছি।’’
যাত্রীদের এই অভিযোগ অবশ্য মেনে নিতে রাজি নন আরপিএফ কৃষ্ণনগর পোষ্টের ইন্সপেক্টর হরমঙ্গত সিংহ। তিনি বলেন,‘‘ উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশেই আমরা এই অভিযান চালাচ্ছিলাম। টানা কুড়ি দিন ধরে প্রচারও করেছি। মঙ্গলবার ধরপাকড় শুরু হয়েছিল।’’ তিনি বলেন,‘‘ এই ক’দিন নজরদারি চালানোর সময় লক্ষ্য করেছিলাম বেশ কিছু লোক নিয়মিত অন্যের জন্য জায়গা রাখছিলেন। এ দিন তাদেরই দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। নিত্যযাত্রীদের চাপে অবশ্য শেষপর্যন্ত তাদের ছেড়ে দিতে হল।’’ বুধবার সকাল থেকে আরও বেশি সংখ্যক ফোর্স নিয়ে জোরকদমে অভিযান চালানো হবে বলে তিনি জানান। এ দিন আরপিএফের ওই ইন্সপেক্টরকে গালিগালাজ করতে দেখা যায় মারমুখী নিত্যযাত্রীদেরকে। বেঙ্গল রেলওয়ে প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়শনের সাধারণ সম্পাদক পুন্ডরীকাক্ষ কীর্তনিয়া বলেন,‘‘ দুজন নিত্যযাত্রীকে ওইভাবে গ্রেফতার করে ঠিক করেনি আরপিএফ। কিন্তু তার জন্য নিত্যযাত্রীরা এ দিন যা করলেন, তা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এর জন্য হাজার হাজার যাত্রীকে চরম হয়রানির শিকার হতে হল।’’ কৃষ্ণনগর স্টেশন ম্যানেজার স্বপন মণ্ডল বলেন,‘‘ বেশ কিছুদিন ধরে প্রচার অভিযান চালিয়ে সকলকে সতর্ক করা হয়েছিল। তার পরেও নিত্যযাত্রীরা জায়গা রাখছিলেন। এদিন তাদের দুজনকে গ্রেফতার করার পর উত্তেজনা ছড়ায়। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা অবরোধ চলে।’’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.