বনের পাখি আর খাঁচার পাখি কেহ কাহারে বুঝিতে পারে না, কখনও আপনাকে বুঝাইতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আর শিল্পপতিদেরও একই সমস্যা। মুখ্যমন্ত্রী শিল্পমহলের ভাষা বুঝেন না। তাঁহার নিকট বিনিয়োগকারীরা কী চাহেন, কেন চাহেন মুখ্যমন্ত্রী আজও বুঝিতে পারেন নাই। অন্য দিকে, দেশের আর পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যখন নিজেদের রাজ্যে শিল্প টানিয়া আনিতে স্বেচ্ছায় বহু মাইল হাঁটিতে প্রস্তুত, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন জেদ ছাড়িতে পারেন না, শিল্পপতিদের নিকট তাহা বিশুদ্ধ হেঁয়ালি। ফলে, একে অপরের কাছে আসিবার ইচ্ছা যত তীব্রই হউক না কেন, তাঁহারা অলঙ্ঘ্য দূরত্বেই থাকিয়া যান। এই দূরত্ব যে মিটিবার নহে, কলিকাতা, দিল্লিতে বেশ কয়েকটি শিল্প-বৈঠকের পর এই কথাটি উভয় পক্ষেরই বুঝিয়া লওয়া উচিত। শিল্পমহল সম্ভবত বুঝিয়াছে। ফলে সম্প্রতি দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে দেশের প্রথম সারির বিনিয়োগকারীরা অনুপস্থিত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়াছেন কি না, তাহা অবশ্য জানা যায় নাই। তিনি শিল্পমহলের মন জয়ে ব্যস্ত। কাজটি যে অতি কঠিন, হিরো মোটো কর্পের কর্তা সুনীল মুঞ্জল বুঝাইয়া দিয়াছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্নে নিজের অবস্থান বদলাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। ইতিবাচক উত্তর পান নাই। তিনি আর বৈঠক শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন নাই। সাংবাদিকদের জানাইয়াও দিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গে এখনই বিনিয়োগ করিতে তাঁহারা আগ্রহী নহেন। শ্রীমুঞ্জল দৃশ্যতই স্পষ্টবক্তা। তবে বাকিরা সৌজন্য বজায় রাখিয়াছেন, অতএব তাঁহারা বিনিয়োগের ঝুলি লইয়া পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছাইতে আকুল, এমন ধরিয়া লইলে ভুল হইবে। তাঁহাদের নীরবতা নিছকই ভদ্রতা, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি সমর্থন নহে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন শিল্পপতিদের সহিত বৈঠক করেন, কেন তাঁহাদের রাজ্যে আহ্বান করেন, তাহা দুর্বোধ্য। শিল্পপতিরা যাহা চাহেন, মুখ্যমন্ত্রী তাহার কোনওটিতেই রাজি নহেন। তিনি জমি অধিগ্রহণ করিবেন না বলিয়া গোঁ ধরিয়া আছেন। তাহাতে ইনফোসিস ফিরিয়া গেলে যাউক, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আটকাইয়া গেলে তাহাও সই, আর মেট্রো রেল তো এখন ‘শত্রু সম্পত্তি’। শিল্পপতিরা নিরাপত্তা চাহেন। মুখ্যমন্ত্রী তাহাতেও না করিয়া দিয়াছেন, এমন বলিলে মিথ্যাভাষণ হইবে। কিন্তু, হলদিয়ায় এবিজি সংস্থার ক্ষেত্রেই হউক দুর্গাপুরে জয় বালাজি ইস্পাত কারখানাতেই হউক, নিরাপত্তা নামক বস্তুটি পশ্চিমবঙ্গে বিলুপ্ত। শিল্পপতিরা আশা করেন, তাঁহাদের কথা শুনিবার মতো সময় মুখ্যমন্ত্রীর থাকিবে। গত দেড় বৎসরে তেমন অভিজ্ঞতা তাঁহাদের হইয়াছে বলিয়া কেহ দাবি করেন নাই। পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিতে এমন কিছুই নাই, যাহার আকর্ষণে শিল্পপতিরা এতগুলি প্রতিকূলতা মানিয়া লইবেন। মুখ্যমন্ত্রী কোনও প্রতিকূলতাই যখন দূর করিবেন না বলিয়া পণ করিয়াছেন, তখন তিনি সেই পণ লইয়াই থাকুন না কেন। অহেতুক নিজের এবং শিল্পপতিদের সময় নষ্ট করিয়া কী লাভ? বরং বিজয়ায় মিষ্টান্ন পাঠাইয়া সৌজন্য সারিয়া লইবেন।
সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর পরিত্যক্ত কারখানা পশ্চিমবঙ্গের প্রতীক। রাজনীতির গতিপথ কিছু ভিন্ন হইলে সেই কারখানা যেমন আজ জমজমাট হইত, তাহাতে বহু লোকের কর্মসংস্থান হইত, সেই কারখানাকে কেন্দ্র করিয়া অনুসারী শিল্পের একটি নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া উঠিত পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎও তেমনই অন্য ভাবে লেখা সম্ভব ছিল। টাটা গোষ্ঠীর বিদায়ী প্রধান রতন টাটা সম্প্রতি আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গকে এই উপহার দিতে চাহিয়াছিলেন সংকীর্ণ রাজনীতি তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা উল্লেখ করিতে ভুলেন নাই। বলিয়াছেন, শ্রীভট্টাচার্য সত্যই পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের চেষ্টা করিয়াছিলেন। বাস্তব জানে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁহার প্রয়াসে সফল হন নাই। শিল্পায়নের রাস্তাতেই তাঁহার এবং দলের রথের চাকা বসিয়া গিয়াছিল। তবু, সেই নির্বাচনের ফলই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁহার শেষ মূল্যায়ন নহে। রতন টাটা যে কারণে তাঁহাকে মনে রাখিয়াছেন, ইতিহাসও তাঁহাকে সেই কারণেই ভুলিবে না। আর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন পরিচয় ভবিষ্যৎ স্মরণ করিবে, তিনি জানেন তো? |