গভীর রাতে চিৎপুর থানা এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে খুন হয়েছিলেন এক বৃদ্ধা। পুলিশের অনুমান, চুরির উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাটে ঢুকলেও বাধা পেয়ে বৃদ্ধাকে খুন করে দুষ্কৃতীরা। এর পর কয়েক মাস কেটে গেলেও ঘটনার কোনও কিনারা করতে পারেননি গোয়েন্দারা।
জানুয়ারিতে কসবায় ছিনতাইকারীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হন গৃহবধূ বিদ্যা দেশাই। ঘটনার পর বছর ঘুরতে চললেও গ্রেফতার হয়নি কোনও অভিযুক্তই।
শুধু এই দু’টি ঘটনাই নয়, গত কয়েক মাসে পরপর ঘটে চলা ছিনতাই-সহ নানা অপরাধের অনেকগুলিরই কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, লালবাজারের গোয়েন্দাদের ‘সোর্স’ নেটওয়ার্ক নিয়ে। এক সময় কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তুলনা চলত। প্রাক্তন পুলিশকর্তারা বলছেন, গোয়েন্দা বিভাগের ‘স্বর্ণযুগে’ অপরাধের কিনারা করতে ‘সোর্স’রা অনেক ক্ষেত্রেই সাহায্য করত। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের কাজে লাগানো হয়।
কারা এই ‘সোর্স’? পুলিশ সূত্রের খবর, ছিঁচকে চোর থেকে যৌনকর্মী, মায় রাজনৈতিক দলের নীচুতলার কর্মী, যে কেউ হতে পারেন ‘সোর্স’। পুলিশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে, এমন লোককেই এলাকার সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এক গোয়েন্দাকর্তা জানান, ছোটখাট অপরাধ করে ধরা পড়া দুষ্কৃতীদের ব্যবহার করতে সাজা খেটে বেরোনোর পরেও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে পুলিশ। অনেক সময় রাস্তার ধারের ভবঘুরে বা মাদকাসক্তেরাও নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। জেল থেকে বেরিয়ে দাগী অপরাধীও পুলিশের ‘সোর্স’ হয়েছে। পুলিশ বলছে, অপরাধ জগত থেকে সরে গিয়েছে প্রমাণ করতেই থানায় যোগাযোগ রাখে তারা। পাশাপাশি, এ ভাবে খবর দিয়ে পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধও নেয় অনেকে।
গোয়েন্দারা বলছেন, অপরাধ জগতে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে মেলা সব খবরই পুলিশকে জানায় ‘সোর্স’-রা। অপরাধীরা ‘ফুর্তি’ করতে যৌনপল্লি ও পানশালায় যাতায়াত করে বলে সেখানে খবর মেলে। সোনাগাছি বা প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মতো যৌনপল্লিতে অনেকে সোর্স হিসেবে কাজ করেন। পুলিশ সূত্রের খবর, এখন বিভিন্ন পানশালায় যাতায়াতকারী যৌনকর্মীদের কাছেও প্রচুর খবর থাকে। এক সময় সোর্সদের খবরের সাহায্যে বহু অপরাধের কিনারা করেছে পুলিশ। সূত্রের খবর, বছর খানেক আগে বৌবাজারের এক ব্যবসায়ী খুনে যৌনপল্লির সোর্স মারফৎ বহু খবর মিলেছিল। অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের মুখও ঘুরিয়ে দিতে পারে সোর্স। যেমন ঘটেছিল পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের ক্ষেত্রে। পুলিশ সূত্রের খবর, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে অন্যতম দুই অভিযুক্ত কাদের ও নাসের ওই এলাকায় পুলিশের সোর্স ছিল। পুলিশি জেরায় বিষয়টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল তারা। যদিও পরবর্তীতে ইলিয়ট রোড এলাকার অন্য একটি সোর্স মারফত বিষয়টি জানতে পারে পুলিশ।
পুলিশের একাংশ বলছেন, ইদানীং গোয়েন্দাদের সোর্স নেটওয়ার্কে কিছুটা ভাটা পড়ার অন্যতম কারণ, সোর্সদের ঠিকমতো টাকাপয়সা না মেলা। পুলিশ সূত্রের খবর, বেশ কিছু ঘটনায় গোয়েন্দা দফতরের সোর্সরা টাকা পায়নি। গোয়েন্দারা জানান, এক সময় দক্ষিণ শহরতলি বা পূর্ব কলকাতার বেশ কিছু সোর্স মারফত ‘অসাধারণ’ খবর মিলত। কিন্তু পয়সা না মেলায় তারা মুখ ফিরিয়েছে। অনেকে ফিরে গিয়েছে অপরাধ জগতে। পুলিশ সূত্রের খবর, সোর্স নেটওয়ার্কের জন্য নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ থাকে। তবে তা পরিমাণে কম, পেতেও দেরি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তদন্তকারীরাই ‘গাঁটের কড়ি’ খরচা করে ‘সোর্স-মানি’ জোগান। সম্প্রতি সেই জোগান কমায় সোর্স নেটওয়ার্কে ঘাটতি এসে যাচ্ছে। গোয়েন্দা দফতরের বিভিন্ন শাখার মধ্যে রেষারেষির জন্যও সোর্স হাতছাড়া হচ্ছে। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “অনেক সময়েই এক শাখার সোর্সকে অন্য শাখার অফিসারেরা গ্রেফতার করেন। আবার সোর্সকে অন্য শাখার অফিসারদের হাত থেকে বাঁচাতেও সাহায্য করেন অনেকে।” বছর কয়েক আগে ট্যাংরায় এক খুনের অভিযুক্তকে আজও ধরা যায়নি। সূত্রের খবর, সেই অভিযুক্ত তৎকালীন গুণ্ডা-দমন শাখার এক অফিসারের সোর্স ছিল। তাঁর ‘সৌজন্যেই’ পার পেয়েছিল ওই অভিযুক্ত। |