ইলিশ, পাবদা, ট্যাংরা যেন আকাশের চাঁদ। দেখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না। মৌরলা, কাজরি স্বপ্নসদৃশ। পার্শে, বাটা, কাটাপোনার দরেও আগুন। এমনকী ‘সমুদ্রের মাছ’ বলে আগে যা দেখে অনেকে নাক সিঁটকাতো, সেই পমফ্রেট এখন রীতিমতো অভিজাত। দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের সাধ্যি কী তার গায়ে হাত ঠেকায়!
তাই রোজের পাতে স্বাদ আনতে মৎস্যবিলাসী নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালির বড় ভরসা ভোলা, ম্যাকারেল, চ্যালা। কিংবা ভেটকি, ফ্যাসা, লটে বা তরোয়াল। সব সামুদ্রিক মাছ। বহরে অতিকায়, লালচে রং। গন্ধের কারণে অনেকের কাছে অচ্ছুত, তাই মিষ্টি জলের মাছের তুলনায় চাহিদা কম। বাজারের নিয়ম মেনে দামও কম। অন্তত এত দিন তা-ই ছিল। ইদানীং ছবিটা বদলে গিয়েছে। সমুদ্রের ভোলা-ভেটকি-লটে তরোয়ালও মহার্ঘ হয়ে উঠছে। কেন?
কারণ, মাছের খরা লেগেছে গভীর সমুদ্রেও! |
এতটাই যে, বহু ছোট ট্রলার বা নৌকা আর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছে না। পড়তায় পোষাচ্ছে না। মৎস্যজীবীমহলের খবর, খরচ উঠছে না বলে মাঝ নভেম্বর থেকে কাকদ্বীপ-নামখানা-ফ্রেজারগঞ্জ-রায়দিঘি-ডায়মন্ড হারবার এবং দিঘা মোহনায় প্রায় পাঁচ হাজার ট্রলার ও অসংখ্য নৌকো সাগরযাত্রা বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ গত এক মাস যাবৎ পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে মাছ ধরা কার্যত শিকেয়। ‘ইউনাইটেড ফিশারমেন্স ইউনিয়ন’-এর চেয়ারম্যান প্রণবকুমার করের কথায়, “মাছ ভাল উঠছে না। ট্রলারের খরচা পোষাচ্ছে না। তাই অনেকে মাছ ধরতে যাচ্ছেন না।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার সহ মৎস্য-অধিকর্তা (সামুদ্রিক) কিরণ দাস জানাচ্ছেন, সুন্দরবনে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া সাগরে কিছু মাছ পাওয়া গেলেও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে মাছের আকাল পড়েছে। তাঁর কথায়, “এই সময়টায় সমুদ্রে মাছ কম থাকে ঠিকই। কিন্তু এ বছর একেবারেই নেই!”
আর এরই আঁচ পড়ছে বাজারে। আম-বাঙালির পছন্দ-তালিকায় পিছিয়ে থাকা সামুদ্রিক মাছও দুর্লভ হয়ে উঠেছে। পাতিপুকুর মাছ-বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী উত্তম হাজরা বলেন, “সমুদ্রের ভোলা, ম্যাকারেল, চ্যালা, ফ্যাসা, লটে ইত্যাদি আর আসছে না বললেই চলে। যেটুকু আসছে, দাম চড়া।”
ফলে গরিব-গুর্বোর হেঁসেলেও মাছের গন্ধে ভাঁটা। কিন্তু মাঝ দরিয়ায় মাছের আকাল কীসের জন্য?
কিরণবাবুর কাছে কোনও ব্যাখ্যা নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের মতে, নিয়ম ভেঙে অত্যধিক মাছ ধরার ফলেই এই বিপর্যয়। প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির সুযোগই পাচ্ছে না মাছের দল। অনেকে এর সঙ্গে উষ্ণায়নকে দায়ী করে বলছেন, সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ার কারণেও মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে, মার খাচ্ছে বৃদ্ধি।
সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মৎস্য-বিজ্ঞানী উৎপল ভৌমিক অবশ্য নির্বিচার মাছ-শিকারের দিকেই আঙুল তুলছেন। “বড় ট্রলারগুলোর বিশাল ব্যাগ নেটে ইলিশ-ভেটকি-পমফ্রেট, ম্যাকারেলের ছোট ছোট চারা ধরা পড়ে যাচ্ছে। মরা চারাগুলোকে সমুদ্রেই ফেলে দিয়ে আসছে। হাজার হাজার কেজি মাছ এ ভাবে নষ্ট হচ্ছে।” আক্ষেপ উৎপলবাবুর। বড় বড় ট্রলারে অতিকায় ব্যাগ নেট-গিল নেটের যথেচ্ছ ব্যবহার দেখে মৎস্যজীবীদের একাংশও সমূহ উদ্বিগ্ন। ফ্রেজারগঞ্জ মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতা শ্যাম বেরার আশঙ্কা, “দিঘার দিকে মাছ শেষ করে বড় ট্রলারগুলো এখন ফ্রেজারগঞ্জ-বকখালিতে আসছে। ওরা কিছু দিন থাকলে এ দিকেও মাছ থাকবে না!” সুরাহা কী?
উৎপলবাবুর দাওয়াই, “ফাঁস অবশ্যই ৯০-১০০ মিলিমিটারের মধ্যে রাখতে হবে, যাতে জালে ছোট মাছ না ঢোকে। বছরে অন্তত ৬০ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। আর দেখতে হবে, ট্রলারগুলো যেন বড় বড় ব্যাগ নেট, গিল নেট নিয়ে সমুদ্রে না যায়।” সাগরের মাছ বাঁচাতে ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তরফে কিছু সুপারিশ রাজ্যের পূর্বতন মৎস্যমন্ত্রী সুব্রত সাহাকে দেওয়া হয়েছিল। উৎপলবাবু বলেন, “মন্ত্রী তা গ্রহণ করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, বিজ্ঞপ্তির আকারে সেগুলো সম্পর্কে মৎস্যজীবীদের অবহিত করা হবে। কিন্তু ফের মন্ত্রী বদল হয়েছে। নতুন মন্ত্রী কী করবেন, বুঝতে পারছি না।”
বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের পরে মৎস্য দফতরটিকে নিয়ে কম নাড়া-ঘাঁটা হয়নি। নতুন সরকারের প্রথম মৎস্যমন্ত্রী ছিলেন আবু হেনা, প্রতিমন্ত্রী মদন মিত্র। পরে মদনবাবুকে সরিয়ে মৎস্য প্রতিমন্ত্রী করে আনা হয় সুব্রত সাহাকে। আবু হেনা মন্ত্রিসভা ছাড়ার পরে সুব্রতবাবু দায়িত্ব নেন। সম্প্রতি সুব্রতবাবুকে সরিয়ে মৎস্যমন্ত্রী করা হয়েছে বোলপুরের বিধায়ক চন্দ্রনাথ সিংহকে। তিনি কী বলছেন?
নতুন মৎস্যমন্ত্রী এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে চন্দ্রনাথবাবু এই প্রতিবেদককে বলেন, “এত তাড়াতাড়ি সব জানা যায়? আস্তে আস্তে খোঁজ নিতে হবে। এই তো আপনার মুখে জানলাম। এ বার খবর নেব।”
তত দিনে হয়তো দরিয়ার দস্যু-জালে আটকে অকালে মরবে আরও কয়েক হাজার কিলো চারা-মাছ। |