খুনের অভিযোগে এক সময়ে ছিলেন জেল-হাজতে। আপাতত অজ্ঞাতবাসে। তবু উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাজনীতিতে সিপিএম নেতা মজিদ আলি ওরফে মজিদ মাস্টার এখনও কতটা প্রাসঙ্গিক, তা ‘নির্দিষ্ট’ করে দিলেন তৃণমূল নেতারাই।
মজিদের প্রাক্তন ‘খাস তালুক’ শাসনে রবিবার সভা করে তৃণমূল। ছিল পঞ্চায়েত ভোটের প্রচার-সভা। কার্যত সেখানে চর্চা হল মাস্টারের নেতৃত্বে শাসনের ভেড়ি এলাকায় খুন-সন্ত্রাসের ভুরি ভুরি অভিযোগ নিয়ে। তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী, সৌগত রায়, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যদের বক্তব্যে বার বারই উঠে এল মজিদ মাস্টারের নাম। মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তো বলেই ফেললেন, “কুখ্যাত সমাজবিরোধী মজিদ। আমরা চাইলে ওঁকে খাঁচায় পুরতে এতটুকু সময় লাগবে না।”
কী বলছেন মজিদ নিজে? গোপন আশ্রয়ে বসে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ছ’ফুট তিন ইঞ্চির মাস্টার বললেন, “যারা মানুষের জন্য কাজ করেন, শেষ জীবনে হয়তো তাঁদের এই অবস্থায় পড়তে হয়। বিদ্যাসাগরেরও এক অবস্থা হয়েছিল।”
এখনও শাসনের হাওয়া-বাতাসে কান পাতলে ভাসে স্থানীয় হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই মজিদ আলিকে নিয়ে অজস্র হাড়হিম করা গল্প। যে সব স্মৃতি উস্কে দিয়েই এই জেলায় ভোটের প্রচারে নামল তৃণমূল। মজিদ-জমানা শেষ হওয়ার পরে এলাকায় শান্তি ফিরেছে বলে তাঁদের দাবি। মজিদ পাল্টা সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
|
মজিদ মাস্টার |
এলাকায় উন্নয়নের প্রশ্নে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তনী মজিদের গলায় আত্মবিশ্বাসের সুর। বললেন, “শাসনের গ্রামে গিয়ে বয়স্কদের প্রশ্ন করুন। এক সময়ে হাজার-হাজার বিঘের যে জমি বর্গাদারদের হাতে ছিল, আমরাই তা সাধারণ মানুষকে বিলি করেছি। যদিও পাট্টা তুলে দিতে পারিনি। মাছ চাষের পাশাপাশি, শুখা মরসুমে ভেড়িতে বোরো ধান চাষের ব্যবস্থা করেছি আমরাই। ব্লকে দশ হাজার ভেড়ি। এলাকার বারো হাজার পরিবার এর উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন।” তাঁর ক্ষোভ, “তৃণমূল এসে সব দখল করে নিয়েছে। এখন নিজেরা মধ্যে খুনোখুনি করে মরছে।”
দীর্ঘ দিন ধরেই শাসন যেন বারুদের স্তূপ। পুলিশ-প্রশাসনের হিসেবে, বহু অস্ত্র জমা আছে সেখানে। সে সব এল কোথা থেকে? মজিদের জবাব, “পাইপগান পর্যন্ত বলতে পারব। তার পরে জানি না। ১৯৯১ সালে ভেড়ি দখল করার জন্য সশস্ত্র আক্রমণ হয়েছিল। ৪ জন সিপিএম কর্মী খুন হন। তখনই শাসনের সাধারণ মানুষ দূরের শত্রুদের হাত থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে লাঠি-কাস্তের বদলে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নেন।” উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য মজিদের বক্তব্য, “এটা ঠিক যে মা-মাটি-মানুষের সরকারের অভিধানে হার্মাদ শব্দটি এসেছে আমার কারণেই। কিন্তু খুন তো করছে ওরাই। ক’জন খুন হয়েছে ওদের? শাসনে এখনও পর্যন্ত আমাদের ২৫ জন খুন হয়েছেন। ২৭৬ জন ঘরছাড়া। পঞ্চায়েতগুলি জোর করে দখলে নিয়েছে ওরা।”
মজিদের নির্দেশই এক সময়ে শাসনের একমাত্র ‘আইন’ ছিল সে কথা মানেন বিরোধীরা। সৌগতবাবু এ দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেন, “৩৪ বছর আমরা এখানে ঢুকতে পারিনি। আগে মজিদের বাড়ির কাছেও যেতে পারেননি তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। তাঁর কনভয় আটকানো হয়। মজিদ মাস্টারের অঙ্গুলিহেলনে মুকুল রায়ের কনভয় আক্রান্ত হয়েছিল এখানেই। এখন আর বোমা-গুলির আওয়াজ শোনা যায় না। এখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন মানুষ।”
এ হেন মজিদ দীর্ঘ দিন শাসন-ছাড়া। ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুনের অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। গ্রেফতার হওয়ার ক’দিন আগে শাসনে আক্রান্ত হয় মজিদ মাস্টারের গাড়ি। পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে আলিমুদ্দিনে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন মজিদ। যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে বিস্তর জলঘোলা হয়। কিন্তু সে সব নিয়ে হেলদোল নেই মাস্টারের। বলেন, “আমার নামে খুনের মামলা রয়েছে। তাই তখন আমাকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী
ঠিকই করেছিলেন।”
মজিদের বাড়ি-সংলগ্ন শাসন খেলার মাঠে দলীয় সভায় শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “গোখরো সাপ কেউ ঘরে পোষে না। বিষধর সাপের সঙ্গে আপনারা যেমন আচরণ করেন, লক্ষ্মণ (শেঠ), সুশান্ত (ঘোষ), মজিদদের সঙ্গেও একই আচরণ করতে হবে। শাসন-খড়িবাড়ি এলাকায় সিপিএমকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিতে হবে।” এ দিন সভায় হাজার তিরিশ জনতার দিকে জ্যোতিপ্রিয়বাবু প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “মাস্টারের কী শাস্তি চান আপনারা?” একযোগে উত্তর ভেসে আসে, “ফাঁসি।” যা শুনে জ্যোতিপ্রিয় অবশ্য বলেন, “আমরা রক্তের বদলে রক্ত চাই না। খুনের বদলে খুন চাই না।”
খুন হয়ে যাওয়ার ভয় পান? প্রশ্ন শুনে বিদ্যুৎ খেলে সত্তরোর্ধ্ব মাস্টারের চোখে। একটু থেমে বলেন, “ক’দিন আগে এক তৃণমূল নেতা ফোন করে বললেন, ‘মরবি কবে’? আমি বললাম, ‘যত দিন তোমরা বাঁচিয়ে রাখবে’।”
|
সহ প্রতিবেদন: সীমান্ত মৈত্র |