শীত পড়লেই ভোগ-নৈবেদ্যতে অনিবার্য স্থান করে নেয় নলেন গুড়। নবদ্বীপের একাধিক মঠ-মন্দিরে দুপুরের ভোগে বাধ্যতমূলক হয়ে যায় নতুন গুড়ের পায়েস। সেই সঙ্গে খিচুড়ি। তাতে থাকে নতুন ওঠা শীতের সব্জি।
নতুন গুড় এক রকম উৎসবেরই বার্তা বয়ে আনে। সেই সঙ্গে বয়ে আনে স্মৃতির সোয়াদ। প্রবীণা কনক সাহার কথায়, “নলেন গুড় কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা যায় না। অন্তত এখনও করা যায়নি। তাই তার স্বাদ কিছু বদলাতে পারে, কিন্তু তা প্রায়ই পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয়।” কনকদেবীর বাড়ি অধুনা বাংলাদেশের কলাকোপা গ্রামে। প্রবীণ অক্ষয় সরকারের কথায়, “নলেন গুড় আসলে এই শহরের জীবনে গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে পড়ে যায় ছেড়ে আসা বাড়ির কথা। আর সেই বাড়ির সঙ্গে মিশে থাকা সব স্মৃতি যেন এই শীতের দিনে ভিড় করে আসে।” হিমে ভেজা সেই দেশভাগের স্মৃতি তাই নলেন গুড়ের মিষ্টিতে যোগ করে দেয় নতুন মাত্রা। একই সঙ্গে, অগ্রহায়ণের শেষে সেই হারিয়ে যাওয়া দেশে নতুন করে ধান উঠত, হত নবান্ন, প্রবাস থেকে ফিরতেন বাড়ির ছেলেরা। তাই পুজোর পরে পৌষ-মাঘে মনে পড়ে যায়, গেরস্থালীর একরকম উৎসব উদ্যাপনই হত নতুন গুড়ের পিঠেপুলি দিয়ে। সেই সঙ্গে ছিল আখের গুড়। তা-ও শীতকালে বেশি মিলত। আখের গুড় দিয়ে সিদ্ধ পিঠে খাওয়ার স্মৃতি বিশেষ করে গঙ্গার ধারের বাঙালির রান্নাঘর এখনও আমোদিত রেখেছে। |
তারই রেশ ধরা রয়েছে মঠ-মন্দিরের ভোগে এবং মিষ্টির দোকানেও। সমাজবাড়ি, চৈতন্যজন্মস্থান আশ্রম, বলদেব মন্দির বা মহাপ্রভু বাড়িতে দেবতার পাতে পড়ছে খেজুর গুড়ের দুধপুলি, ক্ষীরপুলি। শহরের বিখ্যাত সমাজবাড়ির জনক দাসের কথায়, “এ সময়ে সকালে খিচুড়ি ও দুপুরে পরমান্ন রোজ দেওয়া হয়।” বলদেব মন্দিরের কিশোর গোস্বামী জানালেন, খুবই প্রাচীন এবং স্বল্পজ্ঞাত একটি জিভে জল আনা খাবার তৈরির প্রক্রিয়া। তাঁর কথায়, “নারকোল কুচো কুচো করে কেটে, রোদে শুকিয়ে তারপরে নতুন গুড়ের সঙ্গে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে হবে। তাতে ঠিক সময়ে দিতে হবে নারকোলের ছাঁচ। বাদাম শুকনো করে ভেজে তারপরে খেজুর দিয়ে জ্বাল দিয়ে তৈরি হবে সেই শক্ত কিন্তু বেশ সুখাদ্যটি।” মোহন্ত বাড়ির বাবু মোহন্ত বললেন, “চাল গুঁড়ো করে, তারপরে তাকে রোদে শুকিয়ে তৈরি হয় চুষি। সেই চুষি ঘন করে দুধ আর খেজুর গুড় জ্বাল দিয়ে ক্ষীরের মতো করে তাতে মেলানো হয়। একে বলে চুষি পিঠে।” আর নারকোলের পুর ভিতরে দিয়ে বড় পিঠে ওই ক্ষীরে মেশানো হয় ক্ষীরপুলিতে। এ ছাড়া, মুগ পিঠের ভিতরে খেজুর গুড় পুর দেওয়া হয়। গরম তেলে ভাজার সময়ে ওই গুড় গুলে দুর্দান্ত স্বাদ তৈরি করে। চৈতন্যজন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাসের কথায়, “শীতের সময়ে আমাদের খাদ্য তালিকা যেমন বদল হয়, দেবতাদের ভোগও তেমন বদলে যায়। পিঠে, পুলি, পাটিসাপটা, মালপোয়াসব মিষ্টান্নতেই প্রচুর খেজুর গুড়ের ব্যবহার করা হয়।”
যাঁরা রান্না করতে ভালবাসেন, তাঁদের কথা হল, খেজুর গুড় এমনই এক উপাদান, তা নানা খাদ্যদ্রব্যে নানা ভাবে ব্যবহার করা যায়। তরল নলেন গুড় শক্ত পিঠের মধ্যে ভরে দিলেই তা হয়ে যায় অনুপম এক মিষ্টি, যাকে ভেজে বা সিদ্ধ করে পরিবেশন করা যায় অনায়াসে। এমনকী, সাদা খই সাধারণ আখের গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে মুড়কি তৈরি হয়। নদিয়ার বিস্তীর্ণ অংশে খেজুর গুড়ের তৈরি মুড়কির কদর বেশ ভাল।
|
হেমন্তের নূতন গুড়ের গন্ধে আমোদিত বাংলার গ্রামের
বন্দনা সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থের একটি শ্লোকে বিদ্যমান।
বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব
নীহাররঞ্জন রায় |
|
তবে অনেকেরই মতে, খেজুর গুড়ের মিষ্টির মধ্যে সব থেকে কদর বেশি কড়াপাকের সন্দেশেরই। ক্ষীর, কাজু, কিসমিস সহযোগে জয়নগরের মোয়াও বয়সে প্রাচীন হয়েও কদর ধরে রেখেছে। তুলনায় নবীন খেজুর গুড়ের রসগোল্লা। খেজুর গুড়ের দেদো মণ্ডা নামে এক ধরনের মিষ্টিও প্রচলিত এই অঞ্চলে।
নতুন গুড়ের জোড়া সন্দেশেরও বেশ ভালই বিক্রি। ভালই চলে বরফির মতো দেখতে কাজু পেস্তা দেওয়া নলেন গুড়ের সন্দেশও। সাদা ময়দার সঙ্গে কালো জিরে ময়ান দিয়ে আঙুলের মতো লম্বা লম্বা গজার কদরও কম নয়। তাতে ছাঁকা তেলে ভেজে নতুন গুড়ের সঙ্গে গাঢ় রসে ডুবিয়ে তৈরি হয় এই সুস্বাদু গজা। কার্তিক মাস পড়লেই তাই বদলে যায় শ্যামপুরের বিকাশ বিশ্বাস বা গন্ধর্বপুরের গোপাল বিশ্বাসের দিন রাতের হিসেব। শুরু হয়ে যায় গাছ বাওয়ার কাজ। এই সময়টাই যে রসের মরসুম। |