পরিবেশবিদদের প্রশ্নের মুখে আলোর ঝর্না |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করতে না-করতেই বিতর্কের কেন্দ্রে রবীন্দ্র সরোবরের জলে সরকারি উদ্যোগে তৈরি ‘মিউজিক্যাল ফাউন্টেন’। শহরের পরিবেশবিদ ও পরিবেশকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, লেকের জলে রঙিন আলোর ফোয়ারা, তীক্ষ্ণ লেসার রশ্মি ও সাউন্ড বক্স বসিয়ে গানবাজনা সরোবরের পরিবেশের ক্ষতি করছে।
নিজেদের উদ্যোগে লেসার, আলো ও সঙ্গীতের সংমিশ্রণে প্রায় সাড়ে ছ’কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায়’ নামে ওই ফোয়ারা বসিয়েছে পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। তাদের বক্তব্য, ক্ষতির প্রশ্ন নেই, বরং জল, আলো ও লেসারের ওই খেলায় পরিবেশের উন্নতি, পরিবেশ-সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সৌন্দর্যায়নও হবে। |
১২ ডিসেম্বর ফোয়ারার উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী। সরোবরে প্রায় ২০০ বর্গমিটার জুড়ে রোজ সন্ধ্যায় এখন ওই ফোয়ারার প্রদর্শন চলছে। জলে বসেছে নানা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি। একটি দ্বীপে বসানো লেসার সিস্টেমের সামনেই রয়েছে জল ছিটিয়ে তৈরি করা ভাসমান পর্দা। সরোবরের পাড়ে রয়েছে কন্ট্রোল রুম ও দেড় ডজন সাউন্ড বক্স।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, “কলকাতায় খোলা জায়গা শহরের মোট এলাকার এক শতাংশেরও কম। সরোবর শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম খোলা জায়গা, আয়তনে ময়দানের পরেই ৭ লক্ষ ৭৭ হাজার বর্গমিটার। সেখানে মিউজিক্যাল ফাউন্টেন-এর মতো বিনোদনের মাধ্যম পরিবেশের ভারসাম্যকে নষ্ট করবে।” এর প্রতিকার চেয়ে পরিবেশ দফতর ও পর্ষদে চিঠি দিয়েছেন সুভাষবাবু।
আর এক পরিবেশকর্মী বনানী কক্করের বক্তব্য, “রবীন্দ্র সরোবর জাতীয় সরোবর সংরক্ষণ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। আলোর ফোয়ারা ও গানবাজনার শব্দে পাখিদের সমস্যা হবে, পোকামাকড় কমবে, মাছেদের ক্ষতি হবে। সরোবরের পরিবেশ রক্ষায় যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার জোট বদ্ধ হয়ে প্রতিবাদের সময় এসেছে।”
পরিবেশ মন্ত্রকের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ শাখার প্রাক্তন প্রধান আশিস ঘোষের বক্তব্য, “সব চেয়ে অদ্ভুত যে পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, পরিবেশ রক্ষা যাদের কাজ, তারাই রবীন্দ্র সরোবরের ক্ষতি করছেন।” আশিসবাবু ও সুভাষবাবু দু’জনেরই প্রশ্ন, সরোবরের পরিবেশে মিউজিক্যাল ফাউন্টেনের প্রভাব কী হবে, তার মূল্যায়ন হয়েছিল কি না। তবে ফোয়ারা বসানোর কাজ চলাকালীন পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বিষয়টি খেয়াল করেননি।
লেক লাভার্স ফোরাম-এর সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য প্রতিবাদ জানান পরিবেশমন্ত্রী ও পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে। তাঁর কথায়, “পরিবেশমন্ত্রী বলেন, লেকের ক্ষতি হবে না। পর্ষদের চেয়ারম্যান জানান, এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। কিন্তু যা হল, তাতে তো রবীন্দ্র সরোবরের চরম ক্ষতি হয়ে গেল।”
পরিবেশ দফতর ও পর্ষদ অবশ্য সে কথা মানছে না। পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের বক্তব্য, “এই ফোয়ারার জন্য জলে প্রচুর অক্সিজেন পাম্প করতে হয়। এতে সরোবরের জলেরই মান বাড়বে। এই ফোয়ারা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে গায়ের জোরে অভিযোগ তুললেই হবে না।” পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কান্তি দত্ত বলেন, “আলো, লেসার ও শব্দের ব্যবহার যে ভাবে হচ্ছে, তাতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের প্রশ্ন নেই।” রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে কাজ করা আর এক পরিবেশকর্মী মুদার পাথেরিয়াও কিন্তু বলছেন, “এর ফলে জলের মান উন্নত হবে। মিউজিক্যাল ফাউন্টেনে ব্যবহৃত আলোর ৯৫ শতাংশই মৃদু। শব্দ একটা সমস্যা ঠিকই, কিন্তু সে তো বড়জোর আধ ঘণ্টার জন্য। পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে আমি অন্তত মনে করি না।” |