|
|
|
|
বণিকসভার আসরেও পরোক্ষে তরজা মনমোহন-মমতার |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
বণিকসভার আসর। একের পর এক এলেন তিন জন। সকলেরই বিষয় এক, আর্থিক সংস্কার। প্রথম জন মঞ্চ থেকে বললেন, “যাঁরা সংস্কারের বিরোধিতা করছেন তাঁরা হয় বিশ্বের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু জানেন না, না হয় তামাদি (আউটডেটেড) নীতিতেই আটকে আছেন।” পরের এক জন তার প্রতিক্রিয়ায় বললেন, “কী করব, আমি তৃণমূল স্তরের লোক, সাধারণ মানুষের কাছের লোক। আমজনতা তো আউটডেটেড-ই। আমি কিন্তু গর্বিত।” অন্য জন বললেন, “উপর্যুপরি দুর্নীতিই দূষিত করেছে পরিবেশকে। আর এই নীতিপঙ্গুত্বের দায় সরকারেরই।”
ফিকি-র বার্ষিক সাধারণ সভায় এই ভাবে অর্থনীতির সঙ্গে খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে রইল রাজনীতি। যার তিন প্রধান কুশীলব: প্রথম জন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তিন নম্বর লোকসভার বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজ।
রাজনীতি ও অর্থনীতির কারবারিরা বলছেন, তিন জনের কথা থেকেই স্পষ্ট, সরকার যতই অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাক, বিরোধীরা কিন্তু রাজনীতি ছাড়া কিছু দেখছেন না।
মমতার সঙ্গে কিন্তু মনমোহনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরে। যেমন এসেছিলেন সুষমাও। তত ক্ষণে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বণিকসভার মঞ্চ থেকে বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, সংস্কার ছাড়া আর্থিক বৃদ্ধির পথ নেই। সে জন্য প্রয়োজনে তাঁরা নীতি বদলেও তৈরি। একই সঙ্গে, এফডিআই বিরোধিতায় নেমে বাম, বিজেপি, তৃণমূল যে একযোগে আক্রমণ করছে সরকারকে, চড়া সুরে তারও জবাব দিতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ঘরোয়া পরিবেশে অতিশয় নৈরাশ্য তৈরির জন্য বিরোধীদের কার্যত কাঠগড়ায় তুলে তিনি জানান, বৃদ্ধির পথে মূলত সেটাই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে রাজনৈতিক প্রতিকূলতা ও নেতিবাচক বাতাবরণ সত্ত্বেও স্রেফ মানুষের স্বার্থেই সাহস ও প্রত্যয় দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
মনমোহনের এই বার্তাকে ইতিবাচক বলেই মনে করছে শিল্পমহল। তবে রাজনীতির কারবারিদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের রাজনৈতিক তাৎপর্যও কম নয়। জ্বালানির ভর্তুকি ছাঁটাই ও খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির মতো কেন্দ্রের সংস্কার নীতির বিরোধিতায় গত কয়েক মাস ধরে সরগরম সর্বভারতীয় রাজনীতি। সংস্কারে আপত্তি জানিয়ে কেন্দ্রে শাসক জোট ছেড়েছে তৃণমূল। খাতায়কলমে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে সরকার। তাতে আরও উৎসাহী হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে নেমে পড়েছে বাম, বিজেপি। সংসদের ভিতরে বাইরে এফডিআই নিয়ে সমালোচনা করছে সরকারের। সেই সংস্কার-বিরোধিতার জবাব দিতে মনমোহন আজ কৌশলে বেছে নিলেন বণিকসভার মঞ্চকে। শিল্পমহলের সামনে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে চাইলেন সুষমা-মমতাকে।
মনমোহন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “আর্থিক ঘাটতি নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশ। বিশ্বজুড়ে মন্দার কারণে বিনিয়োগকারীরাও লগ্নি করার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিচ্ছে না। সে জন্যই খুচরো ব্যবসা, বিদ্যুৎ, বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির দরজা খোলা হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রের সংস্কার নীতিকে এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে। তা ছাড়া মন্দার গ্রাস থেকে জাতীয় অর্থনীতিকে রক্ষা করার বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক।” বিরোধীদের কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেন, খুচরোর ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে বিরোধীদের তর্ক শুনে মনে হয়েছে, যতটা না ওঁরা এফডিআইয়ের বিরুদ্ধে, তার থেকে বেশি সংগঠিত খুচরো ব্যবসার বিরুদ্ধে।
শুধু বিদেশি লগ্নির জন্য দরজা খোলাই নয়, ভর্তুকি ছাঁটাই নিয়েও একই ভাবে সরব মনমোহন। তাঁর বক্তব্য, অতি দরিদ্রদের স্বার্থে ভর্তুকি অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সবাইকে এটাও বুঝতে হবে, ভর্তুকির বোঝা টানতে গিয়ে পরিকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের টাকা থাকছে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্র যা খরচ করে, জ্বালানি তেল বাবদ ভতুর্কির পরিমাণ তার থেকে বেশি। ফলে গরিব মানুষকে সুরক্ষিত রেখেও ভর্তুকি কী ভাবে কমানো যায় তা ভাবতেই হবে সরকারকে।
আর্থিক বৃদ্ধি সম্পর্কে বণিকসভাকে আশ্বস্ত করতে সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির ইঙ্গিতও দেন মনমোহন। এই প্রসঙ্গে ওষুধ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি, রেলের যাত্রিভাড়া ও পণ্য মাসুল নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন, প্রত্যক্ষ কর বিধি, পণ্য পরিষেবা কর চালু, জমি বিল পাশ করানোর মতো বিষয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
মনমোহনকে অবশ্য পাল্টা জবাব দিতে যথেষ্টই চেষ্টা করেছেন সুষমা। বিজেপি-র এই শীর্ষ নেত্রী বলেন, “উনি গোল টেবিল বিতর্কে বসুন। বিজেপি ওঁর সব বক্তব্যের জবাব দেবে।” তাঁর কথায়, গত সাড়ে তিন বছরে যে ভাবে একের পর এক দুর্নীতি ফাঁস হয়েছে এবং শিল্পপতিদের জেলে পুড়েছে সরকার, তার পর কেউই লগ্নি করতে সাহস দেখাচ্ছেন না। আবার বিপদে পড়ার আশঙ্কায় আমলারাও সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছেন। এই নীতিপঙ্গুত্বের দায় সরকারেরই। একই সঙ্গে তিনি জানান, বিজেপি সংস্কার ও শিল্পায়নের পক্ষে। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যে তাই শিল্পায়ন থেমে নেই।
পাশাপাশি পেনশন ও বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পুরোপুরি বিরুদ্ধেও নয় বিজেপি। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে বিজেপি শুধু এটুকই দাবি জানিয়েছে যে, পেনশনে বিদেশি লগ্নি এলে উপভোক্তাদের ন্যূনতম ফেরত সুনিশ্চিত করা হোক। কিন্তু তা নিয়ে টালবাহানা করে দেরি করেছে সরকার। |
|
|
|
|
|