অল্প সময়ের মধ্যে কলকাতার পথে ত্রিফলা আলো লাগানোর প্রস্তাবে যে খোদ মেয়রের সম্মতি ছিল, প্রকল্প অনুমোদনের নথি থেকেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওই নথিতে অবশ্য সই ছিল না পুর-কমিশনারের। প্রশ্ন উঠেছে, নথিতে পুর-কমিশনারের সই ছাড়া কী ভাবে ওই কাজে সম্মতি দিলেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়?
পুর-বিধি বলছে, প্রকল্প রূপায়ণের নীতিগত সিদ্ধান্ত মেয়রের হাতে থাকলেও তাতে কমিশনারের সায় থাকা বাধ্যতামূলক। তাই অফিসারেরা ফাইলে কোনও ‘নোট’ লিখলে তা ধাপে ধাপে কমিশনারের কাছে পৌঁছয়। পুর-আইন অনুযায়ী, কমিশনারই যে হেতু সরকারি ভাবে প্রকল্প রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী, তাই তাঁর সম্মতি ছাড়া কোনও ফাইল মেয়রের কাছে না-যাওয়ারই কথা। কিন্তু কী ভাবে কমিশনারকে এড়িয়ে ত্রিফলা-ফাইল মেয়রের কাছে গেল এবং তিনি সই-ও করে দিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পুর-প্রশাসনেরই একাংশ। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “মেয়র কেবল নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেন কমিশনার।
ত্রিফলা আলো লাগানোর ক্ষেত্রে কমিশনারকে এড়ানোর যে ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল প্রথা-বিরুদ্ধ নয়, নীতি-বিরুদ্ধও বটে।”
এবং সেই কারণেই অভ্যন্তরীণ অডিটের খসড়া রিপোর্টে তোলা একাধিক অভিযোগের কোনও সদুত্তর দিতে পারছে না পুর-প্রশাসন, এমনটাই মনে করছেন পুর-অফিসারদের একাংশ। শনিবার পুর-সচিবালয়ের এক অফিসার জানান, ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের দাম নির্ধারণ নিয়েও কড়া রিপোর্ট দিয়েছে অডিট সংস্থা। তারা প্রশ্ন তুলেছে, পথে ত্রিফলা লাগাতে বিধাননগর পুরসভা যেখানে বাতিস্তম্ভপিছু ১২০৫০ টাকা খরচ করেছে, সেখানে কলকাতা পুরসভা কেন একই রকম স্তম্ভ ১৭৬৯০ টাকায় কিনেছে? অভিযোগ, এর ফলে শহর জুড়ে ২০ হাজার বাতিস্তম্ভ লাগাতে গিয়ে প্রায় ১৩ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে আর্থিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা কলকাতা পুরসভাকে।
পুরসভা সূত্রের খবর, অডিটে ওঠা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হিমসিম খেতে হচ্ছে পুর-কর্তাদের। এ নিয়ে দিন কয়েক আগেই কসবায় আলো বিভাগের অফিসে বৈঠকে বসেছিলেন দফতরের একাধিক কর্তা। কিন্তু সেখানেও কোনও সমাধানসূত্র মেলেনি বলে পুর-সূত্রেরই খবর। পুর-নথি বলছে, ৩০ নভেম্বর, অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার শেষ দিনে বর্তমান ডিজি (আলো) মনোব্রত চৌধুরী লিখেছিলেন, চিফ মিউনিসিপ্যাল ফিনান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস (সিএমএফএ) অফিসারের অনুমোদনেই বাতিস্তম্ভের দর চূড়ান্ত করেছিলেন তৎকালীন ডিজি (আলো) গৌতম পট্টনায়ক। ওই তথ্য পাওয়ার পরেই মনোব্রতবাবুর কাছে তাঁর লিখিত অনুমোদনের নথি চেয়ে পাঠান পুরসভার চিফ অডিটর বিপ্লব গুহরায়। কিন্তু মনোব্রতবাবু তা দেখাতে পারেননি বলে পুর-সূত্রের খবর।
এর পরেই পুর-নথিতে নিজের বয়ান বদলে দেন মনোব্রতবাবু। নতুন করে লেখা নোটে তিনি বলেছেন, সিএমএফএ নয়, তৎকালীন ডিজি (আলো)-র অনুমোদনক্রমেই বাতিস্তম্ভের দর ধার্য হয়েছিল। তা হলে কেন তিনি প্রথমে সিএমএফএ-এর অনুমোদনের কথা লিখেছিলেন? উত্তর দেননি মনোব্রতবাবু।
শনিবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “ত্রিফলা কেলেঙ্কারি নিয়ে আমরা প্রথম থেকেই সিবিআই তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। এখন ওই ব্যাপারে মেয়র জড়িত থাকার বিষয়টি যখন প্রকাশ্যে এসেছে, তখন আমাদের দাবি যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে।” প্রদীপবাবুর মতোই এ দিন ত্রিফলা-কাণ্ডের সমালোচনা করেছেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। কৃষ্ণনগরে এক দলীয় সভায় তিনি বলেন, “কলকাতাকে লন্ডন বানাতে ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরসভা ত্রিফলা আলো বসিয়েছে। অথচ, মেয়র বা মন্ত্রী হিসেব দিতে পারছেন না!” |