রাসমেলা
মন খারাপ হয় সাগরদিঘি, রসিকবিলে
বাখরখানি লুচি কিন্তু পাইনি। জিলিপির মতো কালজয়ী গতি তার হয়নি। প্রথম রাতে মেলার মাঠেই এক দোকানে রুটি, তরকা, আচারে নৈশাহার সেরেছি। অতি ব্যস্ত সেই ভোজনালয়। রাত পোহাতে কত বছর পরে কোচবিহারের ভোর। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি, পথের ও পারে পার্কে, ব্রাহ্ম সমাবেশালয়ে কুয়াশা নেমেছে। তারও পেছনে নির্মীয়মাণ বহুতল। অন্তত পনেরো তলা তো হবেই। কোচবিহার নগরের পুরোনো স্থাপত্য এখনও দর্শনীয়। তার পাশে এই খাঁচার মতো বহুতলগুলি মানায় না। কাছেই সাগরদিঘি। তার পাড়ে এসে মনখারাপ হয়ে গেল। কী সুন্দর টলটলে জল ছিল। এখন ময়লা। এই সকালেও লোকে সাবান দিয়ে কাপড় কাচছে। কোনও দেবমূর্তির আধডোবা কাঠামো উঁচিয়ে আছে। চারিদিকে অযত্ন, অবহেলা, একটি পাখি নেই। পাখি আর আসে না এখানে। রসিকবিল? রসিকবিলে পাখি এসেছে? শুনলাম, খবরের কাগজে খবর ছিল, এসেছে। যাই তবে। দেখে আসি রসিকবিল। মেলা তো সেই সন্ধ্যায়। মেলা উপলক্ষে বন্ধুরা জড়ো হয়েছি বহু বছর পর। তুফানগঞ্জ, দিনহাটা, কালচিনি, ফালাকাটা এমনকী অসমের বঙ্গাইগাঁও থেকেও এক জন। বড় দল মিলে রসিকবিল চলেছি। বাণেশ্বর হয়ে ফিরব। এক বন্ধুর বালিকা কন্যা অনুযোগ করল মা এখনও আমাকে মেলায় নিয়ে যায়নি। কেন রে? আজ নিয়ে মেলার নবম দিন যে! সে বলে, যাচ্ছিস তো ওই পথে। বুঝবি। ওই পথে? কোন পথ? কোচবিহার থেকে বক্সিরহাট যায় সে প্রতিদিন। তুফানগঞ্জ, বক্সিরহাট। রসিক বিলও একই পথে। সে পথ ভাঙা, বীভৎস ভাঙা। ঠিক যেমন দেখেছিলাম মাদারিহাট থেকে হাসিমারায়। একই অবস্থা পুণ্ডিবাড়ি যেতে, দিনহাটা যেতে। এমন পথে সেই মা প্রত্যহ প্রায় ৭৫ কিমি যায়-আসে। আমি টের পাই তার ক্লান্তি। সেই ক্লান্তি আমার মন ছেয়ে ফেলে রসিক বিল পৌঁছে। বিরাট বিলে পানা পড়েছে। চড়ায় ঢেকে গেছে। গরু-গাভী চরছে। এক কোণে গুটিকয় হাঁস। অযত্নের বনানী। অযত্নের বিল। ডিঙি চালিয়ে মাছ ধরছে রোগা জেলে। বনরক্ষীদের পাশে বসে থাকি চুপচাপ। মেলায় গিয়েছেন? জিজ্ঞেস করি। তাঁরা বলেননা। আগে যেতাম। রাস্তাঘাট খারাপ। ইচ্ছা হয় না।

রাসমেলায় শিল-নোড়ার পসরা। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন হিমাংশুরঞ্জন দেব।
রাসমেলায় গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষ এসে ভিড় করত। চেনা স্বজন পরস্পরের কোমরে দড়ি বেঁধে রাখত যাতে হারিয়ে না যায়। বাচ্চার জুতো-জামা কিনত প্রয়োজনের চেয়ে বড় মাপে যাতে অনেক দিন চলে। এখন সে দিন নেই। গ্রামে-শহরে পোশাকি বিপ্লব ঘটে গেছে। জিন্স, লেগিংস, ব্যাকপ্যাক, স্নিকার্স। তার মানে মেলায় ভিড় কমেনি। দর্শকের ধরন পাল্টেছে। যেমন পাল্টে গেছে গ্রামের চরিত্র। কৃষিক্ষেত্রে বলদের পাশাপাশি ট্রাক্টর চলছে। উন্নতি হয়েছে। হয়ে ভেঙে পড়ছে পাকা সড়কের মতো। একটি মেয়ের মা মেলায় যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। উন্নয়নের অন্যতম শর্ত উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহণ। সেই ব্যবস্থা ধুঁকছে। ট্রাক্টরে চাষের পাশাপাশি চাষির আত্মহত্যাও ঘটে চলেছে ক্রমাগত।
কোচবিহার আগমনের তৃতীয় দিনে সকালে অল্প শীত শীত। সাংবাদিক বন্ধুর বাইকে চেপে চলেছি হরিণচওড়া। তোর্সার পাড়ে। সেখানে আলতাফ মিয়াঁর সঙ্গে দেখা হবে।
মূল রাস্তা ছেড়ে একটি সরু পথে ঢুকতে হল। বাঁধপাড়ের দখলি বস্তি এলাকা। পাথরের বাঁধে উঠে পায়ে পায়ে আলতাফ মিয়াঁর গৃহে পৌঁছলাম। তাঁর বাড়ি বাঁধের অপর পাড়ে নদী ঘেঁষে। বাঁশের বেড়ায় নতুন টিনের আড়াল পড়েছে। নিকোনো উঠোনে প্রবীণ কুলগাছ। নদী ঘেঁষে সজনে গাছ, কলাগাছ। নিঃশঙ্ক কাঠঠোকরা, দোয়েল, কোকিল উড়ে আসছে। বসছে। ডাকছে। উঠোন ছুঁয়ে তোর্সা নদী। আঙিনায় চেয়ারে বসেছি। বর্ষায় নদী আঙিনা ভিজিয়ে ঘর-দুয়ারে ঢুকে পড়ে। তবু আলতাফ মিয়াঁ এখানেই বসবাস করছেন প্রায় বছর পঁচিশ। দারিদ্র প্রবলতর ছিল। সম্প্রতি মদনমোহন মন্দির ট্রাস্ট একটি কাজ দিয়েছে তাঁকে। আলতাফ মিয়াঁ বলেন। আমরা শুনি। রাসচক্র প্রথম তৈরি হয় তাঁর পূর্বপুরুষ পানমামুদ মিয়াঁর হাতে। বাঁশের ওপর সাদা কাগজের কাজ। তার ওপর বত্রিশটি দেবতার মুখ। এবারে সংযোজিত হয়েছে মদনমোহনের মুখ। কথা বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন আলতাফ মিয়া। বলেন, ‘আমার দারিদ্র আছে। কিন্তু দিন চলে যায়। লোভ আমি করি না। ১৭০ বছর ধরে আমরা এ কাজ করছি। এ কাজ সম্মান দিয়েছে। আমার ছেলে আমিনুর কাজ শিখেছে। সেও করবে। মেলা আরও অনেক বছর থাকবে।’
তাঁর কথা আমার ভাল লাগে। বাঁধপাড়ের সংগ্রামী জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে ফিরতে ফিরতে বিষণ্ণ লাগে। বন্ধুটি বলে এ সব দেখলে মনে হয়, আমি খুব ভাল আছি।... আরও এক বার মনে হয়, কাকে বলে ভাল থাকা? কোন তুলনায়?
এই মেলায় প্রতিবেশী জেলা, রাজ্য এবং দেশ মিলেছে, ইতিহাস মিলেছে, ধর্ম, সংস্কৃতি মিলেছে। কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য। বিশাল রাজবাড়ি তার সাক্ষী। কোচবিহারের ঐতিহ্য সংরক্ষিত হোক। প্রচারিত হোক। রাজবাড়ির পাশের জমিটি বহু বছর ধরে গোলাপ বাগান হয়ে ওঠার প্রতীক্ষায় আছে। সে প্রতিশ্রুতি ফুলে ফুলে ভরে উঠুক দ্রুত! রাসপূর্ণিমার চাঁদ কিরণ ঢালবে তার ওপর। শত শত বছর।

(শেষ)


রাসমেলার মেয়াদ বাড়ল আরও দু’দিন
রাসমেলার মেয়াদ বাড়ানো হল আরও দুই দিন। বৃহস্পতিবার কোচবিহারের জেলা পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে এই নিয়ে জেলাশাসকের আলোচনার পরে রাস মেলার মেয়াদ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ বার মেলা ১৫ দিনের বদলে শুরুতেই ১৮ দিন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার পরেও ব্যবসায়ীদের তরফে মেলার মেয়াদ আরও কয়েক দিন বাড়ানোর ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে আর্জি জানানো হয়। জেলাশাসক মোহন গাঁধী বলেন, “১৪ ডিসেম্বর মেলা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আরও দুই দিন মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর মেলা শেষ হবে।”

রাসের টুকরো
• চিনির হাতি-ঘোড়া। দাম ৮০-১০০ টাকা কেজি। বড়রাও ওই মিষ্টির স্বাদ চেখে দেখার সুযোগ পারছেন না।
• ৫০ টাকায় হাওয়াই চপ্পল। মেলার মাঠে চাদর পেতে ডাঁই করে রবারের বিপুল চপ্পল সম্ভার রাখা আছে।
• শিল্পীদের নিরাপত্তার জন্য মেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চ সংলগ্ন অস্থায়ী দোকান সরিয়ে দিয়েছে রাস মেলার আয়োজক কোচবিহার পুরসভা। উদ্যোক্তারা এই দিন জানিয়েছেন, মেলার মঞ্চে বুধবার রাতে মুম্বইয়ের শিল্পী বিনোদ রাঠোরের অনুষ্ঠান হয়েছে। আজ, শুক্রবার গান গাইতে কুমার শানুর আসার কথা। তাই নিরাপত্তা নিয়ে এত কড়াকড়ি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.