কাকভোরে আর চায়ের দরকার হয় না তাঁর। এক সময় নিয়ম করে ভোরে উঠতেন। চায়ের জল বসিয়ে ঘুমচোখে দেখতেন কখন যেন পাশে স্ত্রী হাজির। জলে চা-পাতা দেবেন। আজ মণিকা মুখোপাধ্যায় বেঁচে নেই। প্রবীর মুখোপাধ্যায়েরও দায় নেই সাতসকালের পুরোনো অভ্যেসটা ধরে রাখার।
রাতে ঘুম আসতে চায় না এখন। ঠায় চেয়ে থাকেন দেওয়ালে টাঙানো দু’টো ছবির দিকে। স্ত্রীর, মেয়ের। সিএবি থেকে ফেরেন এখন দেরি করে, সন্ধে পেরিয়ে। “কী হবে ফিরে? মণিকা যখন ছিল, সাতটার মধ্যে না ফিরলে রাগ করত। সন্ধের চা-টা খেতাম একসঙ্গে,” যখন বলেন, কথা আটকে যায়। চোখের কোনায় লুকিয়ে থাকে কয়েক ফোঁটা জল।
|
আদালতের শুনানির দিনগুলো অসহ্য ঠেকে আজ। মেয়ে পৌষালির মৃত্যুর-মামলা যে চলছে কোর্টে। আত্মহত্যা না কি হত্যারায় এখনও দিতে পারেনি আদালত। “ঘা-টা যত শুকোতে চাই, ততই যেন আরও নতুন করে সব মনে পড়িয়ে দেয়। আমি চাইনি মামলা উঠুক। কী হবে? মেয়েকে ফিরে পাব?” তিরাশি বছরের এক বৃদ্ধের বুকফাটা আর্তনাদ যেন মুহূর্তে মিশে যায় শ্যামবাজারের ওই বনেদি বাড়ির আনাচে-কানাচে। ঠাকুরদালানে।
এন শ্রীনিবাসন জানেন এই ঘটনাগুলো? জানেন, সাত দিনের মধ্যে স্ত্রী-কন্যা হারালে কতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে মানুষ? জানেন, তাঁর ঘোষিত ‘শত্রু’ আজ বন্দি থাকেন এক কামরার ছোট্ট একটা ঘরে? একাকী। নিঃসঙ্গ।
ময়দানে হালফিল নতুন একটা নাম হয়েছে ইডেন কিউরেটরের। প্রবীরকে এখন লোকে ডাকে ‘ক্রিকেটের বাঘা সোম’ বলে। শ্মশানে ছেলেকে পুড়িয়ে একটু দেরিতে বড় ম্যাচে ঢুকেছিলেন ইস্টবেঙ্গল-অন্ত প্রাণ বাঘা। আর স্ত্রী-কন্যা হারানোর দু’দিনের মধ্যে ইডেনে পিচ তৈরির কাজে নেমে পড়েছিলেন প্রবীর। সেটা জুন মাস, এ বছরেরই। “মোহনবাগান কোচ পলাশ (নন্দী) ওর প্লেয়ারদের ডেকে বলেছিল, দ্যাখো কমিটমেন্ট কাকে বলে। কিন্তু ইডেনে তো আমাকে আসতেই হত। পরের দিন লিগের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ছিল,” বলে হেসে ফেলেন প্রবীর। আঙুল উঁচিয়ে দেওয়ালে একটা ছবি দেখিয়ে বলতে থাকেন,
|
মহারাজের সঙ্গে |
“কমিটমেন্ট, ডেডিকেশন সবই শিখেছি বাবার কাছে। বাবা বলতেন, শিরদাঁড়াটা সব সময় সোজা রাখবি। যদি একবার ঝুঁকে পড়িস, জানবি তুই শেষ।”
তাঁর এই পিতৃ-মন্ত্রের শক্তির নমুনা সৌরভ বুঝেছেন। গ্রেগ চ্যাপেল বুঝেছেন। এন শ্রীনিবাসনও টের পাচ্ছেন। ‘মুখ বন্ধ রাখো, নইলে গর্দান যাবে’ নির্দেশও তো গঙ্গার জলে নিক্ষিপ্ত। অদ্ভুত-অদ্ভুত কত গল্প লুকিয়ে প্রবীরের জীবনে। পিচ রিপোর্ট করতে আসা জিওফ্রে বয়কটকে ইডেন পিচের চৌহদ্দিতে ঢুকতে দেননি। সাত বছর আগে দ্রাবিড়ের ভারতকে সবুজ পিচে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই সে দিনও মাইক আথারটনকে বের করে দিয়েছেন। কেন করেন এমন? “প্রিন্সিপল বলে তো একটা কথা আছে। ক্রিকেটের নিয়মেই বলা আছে, ও ভাবে কেউ যখন-তখন পিচের সামনে যেতে পারে না। আজ দেখছেন না, ওয়াংখেড়ের কিউরেটর সুধীরের (নায়েক) কী অবস্থা। মুখ খুললে নাকি চাকরি যাবে। ক্ষমতা থাকলে আমাকে বলুক না।” শুনলে কড়া ‘হেডস্যার’ মনে হবে। জীবনের সর্বত্রই বুঝি নিয়মের কাঁটাতার। এক ইঞ্চি আলগা নেই। আদতে ভুল।
মাঠের প্রবীর এক। মাঠের বাইরের প্রবীর অন্য।
সেখানে যুবক প্রবীর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন কার্তিক বসু-র পিচ তৈরির কাজ দেখতে।
বলতে পারেন, “আমার সে অর্থে কোনও গুরু নেই। উনি-ই যতটুকু যা। ও রকম দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকার পর কার্তিকদা-ই একদিন বললেন, এই তুই এখানে রোজ কী করিস? আমি সব বুঝি। উনি কিন্তু যাকে-তাকে শেখাতেন না।” সেখানে স্ত্রীর সঙ্গে এক অদ্ভুত দাম্পত্য ‘রফাসূত্রে’র জন্ম হয়। স্ত্রী-কে বলতে পারেন, “আমি মারা গেলে যদি তুমি আমিষ ছাড়তে পারো, তা হলে আমিও পারব।” প্রবীর পেরেছেন। কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্নও কি নন? মেয়ে মারা যাওয়ার পর স্ত্রীকে তো বলেছিলেন, “শোনো, আমরা আর কোনও শুভ অনুষ্ঠানে যাব না। বিয়ে-টিয়ে কোথাও না।” কোনও এক সন্ধিক্ষণে আবার চরম আত্মভোলা। নইলে সাড়ে বারো লক্ষের প্রভিডেন্ট ফান্ডের চেক কেউ রাস্তায় ফেলে আসতে পারে? যা কিনা আজীবনের সঞ্চয়! সময়ে আবেগেও ভাসেন, চিৎকার করে ওঠেন অন্যায় দেখলে। সদ্যসমাপ্ত ইডেন টেস্ট নিয়ে যেমন স্ফুলিঙ্গ বেরোল। “এত টাকা পায় আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা। আর মালিদের কত দিয়ে গেল? হাজার! মাত্র হাজার টাকা! ছ্যাঃ।”
জীবনে প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলেছেন বহু। সিএবি-র যুগ্ম-সচিব, সহ-সচিব ছিলেন। ছোটবেলায় গাড়ি দুর্ঘটনায় বাঁ পা জখম হওয়ার পরপরই নিয়তির লিখন জানতেন। ক্রিকেটার হওয়া আর কপালে নেই। তবে কর্মকর্তা হতে পারবেন। সুবার্বন ক্লাব থেকে যা শুরু। তবে সে জীবনটাও উপভোগ করেননি বিশেষ। “বরং কিউরেটরের কাজটা করতে বেশি ভাল লাগত। এখানে ক্রিকেটের সঙ্গে যোগাযোগটা বেশি থাকে। সিএবি-র কর্তা হতে বিশেষ গুণাবলির প্রয়োজন হয় না,” অকপটে বলে দেন। আর ভাল লাগাটা এতই মারাত্মক যে, আজও চরম টেনশনে ভোগেন ইডেনে কোনও ম্যাচের আগে। ভোরে উঠে প্রাণায়াম করেন। আরাধ্যকে ডাকেন মনে-মনে। “অনেকটা ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার মতো। যতক্ষণ না ম্যাচ শেষ হয়, স্বস্তি পাই না।”
অবাক লাগবে দেখলে। কথা শুনলে। জীবনের এই মোহনায় যেন হাত ধরাধরি করে হাঁটে তাঁর দুই সত্তা। এক দিকে তিরাশিতেও তিনি ঋজু। ব্যতিক্রমী। আর পাঁচজন বাঙালি বৃদ্ধের মতো অশীতিপর নন। শৃঙ্খলার কড়া বন্ধনে আবদ্ধ। মদ, সিগারেট, কোনও নেশা নেই। বোর্ড প্রেসিডেন্টের শাসনের নির্মম চাবুক যিনি ‘ধুত্তোর’ বলে উড়িয়ে দিতে পারেন। অন্য দিকে, এই একই লোক ভিতরে ভিতরে দুমড়ে-মুচড়ে থাকেন। শেষের সে’দিন গোনেন। স্ত্রী নেই, মেয়ে নেই, জীবনে আর কী পড়ে?
এন শ্রীনিবাসন জানেন, কতটা পথ হেঁটে গেলে প্রবীর হওয়া যায়? |