প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে কলকাতা হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সুর নরম করে ফেলল রাজ্য সরকার। শুক্রবার তারা জানিয়ে দিয়েছে, আদালত নির্দেশ দিলে প্রাথমিক শিক্ষক পদে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদের জন্য পৃথক পরীক্ষা নিতে তাদের আপত্তি নেই। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত শিক্ষা দফতরের এক কর্তা এ দিন বলেন, “কেন্দ্রীয় শিক্ষার অধিকার আইনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণহীনদের জন্য পৃথক পরীক্ষার কথা বলা নেই। তবে হাইকোর্ট সেই নির্দেশ দিলে রাজ্য তা মেনে নেবে।”
সাম্প্রতিক সঙ্কট কাটাতে এ ছাড়া যে আর কোনও রাস্তা নেই, রাজ্যের শিক্ষা দফতরের কর্তারা সেটা বুঝতে পেরেছেন। হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেওয়ায় ৫৫ লক্ষ চাকরিপ্রার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে প্রায় ৫০ হাজার পদ খালি থাকায় নিত্যদিনের পঠনপাঠনে যে-সমস্যা দেখা দিয়েছে, তা আরও জটিল হয়েছে। এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করছে চাকরিপ্রার্থীদের ভাগ্য।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অফিসারদের একাংশ জানাচ্ছেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে যে-জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তির পথ রয়েছে সরকারের হাতেই। ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই)-এর সিদ্ধান্ত তারা যে মেনে নিচ্ছে, হাইকোর্টে তা জানিয়ে আবেদন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণহীনদের পরীক্ষা আলাদা করে নিলেই সমস্যা মিটে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের পরে রাজ্য সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা ওই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করবে। কিন্তু শুক্রবারেই এ ব্যাপারে সরকারের সুর অনেক নরম হয়ে যায়। দু’সপ্তাহের মধ্যে হাইকোর্টে হলফনামা জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সেই হলফনামায় রাজ্য সরকার কী বলবে, তার ইঙ্গিতও এ দিন দেন শিক্ষাকর্তারা। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বাড়তি সুবিধা হিসেবে তাঁদের যে অতিরিক্ত ২০ নম্বর দেওয়া হচ্ছে, তা হাইকোর্টকে জানাবে রাজ্য। সেই সঙ্গেই জানানো হবে, ওই প্রার্থীদের নিয়োগের কাজ আগে সম্পন্ন করা হবে।
কিন্তু এ ভাবে হলফনামা দিলে সমস্যা বাড়বে বলেই মনে করছেন এই মামলার সঙ্গে জড়িত আইনজীবীদের একাংশ। কারণ, প্রশিক্ষিতদের বাড়তি ২০ নম্বর দেওয়ার প্রস্তাব যে আইনবিরুদ্ধ, বৃহস্পতিবার সেটা আদালতেই জানিয়েছিলেন এনসিটিই-র আইনজীবী। তা ছাড়া ৫৫ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তকে খুঁজে বার করে কী ভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন আইনজীবীরা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার ঠিক করেছে, তারা আদালতের নির্দেশ মেনে চলবে।
এ দিন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ, স্কুল সার্ভিস কমিশন, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা এবং স্কুলশিক্ষা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক ছিল শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিই সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর। বৈঠকের পরে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এক কর্তা বলেন, “নিয়োগের পদ্ধতির ব্যাপারে এনসিটিই-র কোনও নির্দেশ নেই। রাজ্যের নিয়মে বা কেন্দ্রীয় শিক্ষার অধিকার আইনেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন প্রার্থীদের জন্য পৃথক পরীক্ষার কোনও সংস্থান নেই। কিন্তু হাইকোর্ট যদি পৃথক পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগের নির্দেশ দেয়, তা হলে তো সেটা করতেই হবে। আদালত যা চাইবে, সেটাই মানা হবে।” শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। হাইকোর্টে আবেদনকারী প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের হয়ে সওয়াল করছেন আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সরকারি হিসেবে রাজ্যে আপাতত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থীর সংখ্যা ১৪ হাজার। শূন্য পদের সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সরাসরি নিয়োগ করে অবশিষ্ট শূন্য পদগুলির জন্য পরীক্ষা নেওয়া দরকার। বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্টও এই মর্মে রায় দিয়েছে।” সরকার অবশ্য এই বক্তব্য মানতে রাজি নয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক কর্তা বলেন, “সরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দিয়েই নিয়োগ করতে চায়। তবে কেন্দ্রীয় শিক্ষার অধিকার আইন মেনে সকলকেই টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট (টেট) দিতে হবে। সমস্যার সমাধানে হাইকোর্ট আমাদের যা করতে বলবে, আমরা সেটাই করব।” |