সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলেন কিন্তু যথাযথ পরীক্ষা না-করেই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হল এমন অভিযোগ ভূরি ভূরি মেলে। কিন্তু এ বার খোদ এক বিধায়ককে উপযুক্ত চিকিৎসা না-দিয়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠল। সেই সঙ্গে সরকারি চিকিৎসা পরিষেবাতেও ‘আমরা-ওরা’ প্রসঙ্গ তুলে সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনল বিরোধী বামফ্রন্ট।
গত মঙ্গলবার অধিবেশন চলাকালীন বিধানসভা কক্ষে মারামারির ঘটনায় মাথায় চোট পেয়েছিলেন পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। বিধানসভার চিকিৎসক তাঁকে এসএসকেএমে রেফার করেন। সেখানে সিটি স্ক্যান করে চিকিৎসকেরা বলে দেন, গৌরাঙ্গবাবুর আঘাত গুরুতর নয়। তাঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও দরকার নেই।
অথচ শুক্রবার একবালপুরের একটি নার্সিংহোমে করা গৌরাঙ্গবাবুর সিটি স্ক্যান রিপোর্ট একেবারে অন্য কথা বলছে। ওই রিপোর্ট হাতে নিয়ে বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী (যিনি নিজেও চিকিৎসক) সূর্যকান্ত মিশ্র শুক্রবার দাবি করেছেন, গৌরাঙ্গবাবুর ডান চোখের উপরে করোটির হাড়ে (‘রাইট টেম্পোরাল বোন ক্লোজ টু দ্য রুফ অফ দ্য অরবিট’) চিড় পাওয়া গিয়েছে।
তিন দিনের ব্যবধানে একই মানুষের দু’রকম স্ক্যান রিপোর্ট হয় কী করে? এতে কি আবার নতুন করে সরাকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠল? এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের জবাব, “আমাদের কাছে সিটি স্ক্যান রিপোর্টের কপি আছে। আমাদের পরীক্ষার যথার্থতা নিয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই।” তা হলে কি নার্সিংহোমে করা পরীক্ষা ভুল? ওই নার্সিংহোমের কর্ণধার গৌতম পুরকায়স্থ-র বক্তব্য, “আমরা সিটি স্ক্যান করে টেম্পোরাল বোন ফ্র্যাকচার পেয়েছি। সেটাই জানানো হয়েছে।” |
ওই রিপোর্ট উল্লেখ করেই এ দিন সূর্যকান্তবাবুর অভিযোগ, “আমরা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানি, রাজ্য মন্ত্রিসভার এক সদস্য এর পিছনে আছেন। সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে বাম বিধায়কদের চোট হালকা করে দেখানোর জন্য সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের উপরে চাপ সৃষ্টি করেছে।” চিকিৎসকরাও চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছেন বলে সূর্যবাবুর দাবি। তাঁর কথায়, “যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে এখন স্বাস্থ্য দফতরে, তাতে কোনও চিকিৎসকই মুখ খুলতে সাহস পাবেন না! কখন কোথায় বদলি করে দেবে, কোথায় পাঠিয়ে দেবে (সরকার)!” সূর্যবাবু নিজে চিকিৎসক। তাঁর বক্তব্য, এক জনকে মাটিতে ফেলে মারা হল। চিকিৎসার নিয়ম বলে, এই অবস্থায় আহতকে অন্তত এক দিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। বিশেষত গৌরাঙ্গবাবু যখন হার্টের রোগী। কিন্তু সেটা করা হয়নি। কেন? সূর্যবাবুর দাবি, “আসলে উপর থেকে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশ ছিল, যাতে গৌরাঙ্গবাবুকে কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি করা না-হয়। তার বদলে বিধায়ককে বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজির আউটডোরে রেফার করা হল! সরকার পক্ষের বিধায়ক হলে এক রকম ব্যবস্থা, বিরোধী পক্ষের হলে অন্য রকম এর একটা লজ্জাজনক নজির হয়ে থাকল এই ঘটনা।” প্রসঙ্গত, মঙ্গলবারের ঘটনায় আহত তৃণমূল বিধায়ক মেহমুদা বেগমকে ভর্তি করে নেওয়া হয়েছিল এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে।
সরকারি হাসপাতাল থেকে যদি এক জন বিধায়ককে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে, তবে সাধারণ মানুষ কী করে সেখানে যেতে ভরসা পাবেন? এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের জবাব, “কোনও মন্তব্য করব না।”
সে দিনের ঘটনায় সিপিএমের আর এক আহত বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী দেবলীনা হেমব্রমের প্রাথমিক ইউএসজি কেন এসএসকেএমে করা হয়নি, সে প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধী দলনেতা। এর উত্তরে এসএসকেএমের অধিকর্তা বলেন, “আমাদের চিকিৎসকেরা যা সঠিক ভেবেছেন সেটাই করেছেন। দেবলীনাদেবীর পেটে আঘাত লাগলে ইউএসজি করা হত। যেহেতু আঘাত সেখানে নেই, তাই ওই পরীক্ষা হয়নি।”
চিকিৎসায় পক্ষপাতের অভিযোগ তোলার পাশাপাশি ঘটনাটি নিয়ে মানবাধিকার কমিশন এবং আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে সিপিএম। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ কথা জানান। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও দলীয় সূত্রের খবর। সিপিএমের পাশাপাশি এই বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের সমালোচনায় নেমেছে কংগ্রেসও।
কংগ্রেসের মানস ভুঁইঞা বলেছেন, “গুরুতর অভিযোগ। এক জন বিধায়ককে বিধানসভার চিকিৎসক এসএসকেএমে পাঠালেন। সেখানে যদি চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে, তা হলে বিধায়ক ‘পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজ’ তুলে স্পিকারকে বিষয়টি জানাতে পারেন।”
মানসবাবুর আরও বক্তব্য, “এর তদন্ত হওয়া উচিত। যদি দেখা যায় যে, এসএসকেএমের চিকিৎসক ইচ্ছাকৃত ভুল করেছেন তা হলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ। আর যদি দেখা যায় অনিচ্ছাকৃত ভুল, তা হলে সেই চিকিৎসকের এসএসকেএমের মতো সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে থাকা উচিত নয়।” বিধানসভায় স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “ওই দিনের ঘটনাকে আমি আগেই দুর্ভাগ্যজনক বলেছি। কিন্তু আমি তো আর চিকিৎসক নই। ফলে রিপোর্টে কী আছে বা চিকিৎসকরা কাকে ভর্তি করবেন, তা নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারি না।”
|