ব্যাগ গুছিয়ে... তাসখন্দের মিনারে...
মুখ চাই মুখ?
আমাদের দেখেই সাগ্রহে জানতে চাইলেন সের্গেই। বছর বাইশের রুশ শিল্পীর হাতে তুলি। সামনে ক্যানভাস। পাশে ফাঁকা টুল। ওই টুলে বসিয়ে দক্ষিণার বিনিময়ে সের্গেই আগ্রহীদের মুখের ছবি আঁকেন। কিন্তু হাতে যে সময় নেই! সের্গেইয়ের চটজলদি উত্তর, “বারো মিনিটে এঁকে দেবো।”
সের্গেইয়ের মতো অন্তত জনাপঁচিশ শিল্পী বসেছিলেন শিল্পী-মহল্লায়। তাসখন্দের ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়্যারের এক পাশে অপরূপ পরিবেশে এই মহল্লা। সবুজ বন, পাখির কলতান সব মিলিয়ে ছবি আঁকার আদর্শ পরিবেশই বটে। কায়রোয় তেহরির স্কোয়্যার, বেজিংয়ে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যার পৃথিবীর বহু শহরেই দেখার মতো একটা চত্বর আছে। কিন্তু তাসখন্দের হৃৎপিণ্ডে এত বড় এলাকা জুড়ে যে স্কোয়্যার, তার মতো আর কোথাও আছে কি না, জানি না।
উজবেক প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে ১৯৯৮-’৯৯-এ তৈরি পার্কটিতে বসে আছে পেল্লাই একটি ধাতব মা, গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখে। সামনে সর্বক্ষণ জ্বলছে অগ্নিশিখা। দামি পাথরের বেদিতে লেখা ‘Sen doim qalbimizdasan jigarim’, অর্থ ‘তুমি সর্বদাই রয়েছে আমার মনের মাঝারে’। যুদ্ধে যাওয়া উজবেকদের জন্য দেশমাতৃকার চিন্তার প্রকাশ এটি। কাছেই একটি সুদৃশ্য ভবনের বারান্দায় সার দিয়ে ধাতব বই। তার পাতায় পাতায় লেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত উজবেক সেনাদের নাম। ১৬টি সুদৃশ্য স্তম্ভের উপর অসাধারণ ফটক। উচ্চতা ৩০ ফুটের মতো। উপরে দু’টো উড়ন্ত সারস।
প্রতীকী মায়ের আরও একটি অনুপম বিশাল মূর্তি আছে স্কোয়্যারে। সংলগ্ন বেদির উপরে বিশাল ধাতব গোলাকার ‘পৃথিবী’। তাতে উজবেকিস্তানের অবস্থান চিহ্নিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ১৯৯১-এ স্বাধীন হয় এই দেশ। ওই বেদিতে ছিল লেনিনের মূর্তি। স্বাধীনতার পরে সেটিকে সরিয়ে বসানো হয় ‘পৃথিবী’। কোথাও ছোটদের খেলার হরেক আয়োজন। কোথাও রাজহাঁসের পাল ভেসে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছ জলাশয়ে। মালবেরি, প্লাটান, পাতাবাহার, ঝাউ হরেক রকম গাছ আর রংবেরঙের ফুল। স্কোয়্যারের ব্রডওয়ে স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাবেন গ্র্যান্ড অপেরা হাউস। নানা মাপের গোটা পঞ্চাশ ফোয়ারা রয়েছে স্কোয়্যারে।
‘তাসখন্দ’ মানে পাথুরে শহর। ২০০৮-এ এর সরকারি হিসেবের জনসংখ্যা ছিল ২২ লক্ষ। এখন সেটা বেড়েছে। বেসরকারি হিসেবে অবশ্য সংখ্যাটা দ্বিগুণ। এ শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর স্মৃতি। ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সইয়ের পরে তাঁর মৃত্যু হয়। লালবাহাদুর যে হোটেলে ছিলেন, আমরাও উঠেছিলাম সেখানে। লালবাহাদুরের আবক্ষ মূর্তি আছে শহরে। একটি রাস্তাও ওঁর নামে।
এক বার চেঙ্গিস খান শহরটা ধ্বংস করেছিলেন। তৈমুরের শাসনকালে পুনর্গঠনের নানা কাজ হলেও কাঝাক, ইরান, মঙ্গোলদের হানা সইতে হয়েছে শহরটাকে। ১৯১৮-য় শহরটা তুর্কেস্তান অটোনোমাস সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের রাজধানীর স্বীকৃতি পায়। ১৯৩০-এ সমরখন্দের বদলে তাসখন্দ উজবেকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৬৬-র মাঝামাঝি ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হলে সোভিয়েত সরকার সাজিয়ে দেয় শহরটিকে।
সাজানো শহর। চওড়া রাস্তাঘাট, হকারমুক্ত ফুটপাথ, বহুতল, চোখধাঁধানো শপিং মল রয়েছে আধুনিক সব উপকরণই। রুটের বাসগুলোও ঝকঝকে, মার্সিডিজ বেঞ্জ-এর তৈরি। আমরা গিয়েছিলাম ওঁদের জাতীয় কবি আলিশার নাভয়ের নামাঙ্কিত পার্কেও। সাজানো বাগানে তাঁর মূর্তি। ওঁর নামে তাসখন্দের অন্যতম প্রধান একটা রাস্তা। ওই রাস্তার ধারে তাঁর নামে অপেরা এবং ব্যালে হল। সমসাময়িক রাজনীতি, সাহিত্য, কবিতা, চিত্রকলাসব কিছুতেই বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর জন্মের ৫০০ বছর উপলক্ষে ১৯৪২ সালে সোভিয়েত সরকার এক জোড়া ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ’৯১-এ ৫৫০ বছর উপলক্ষে সোভিয়েত সরকার প্রকাশ করে আরও একটি ডাকটিকিট এবং এক রুবলের মুদ্রা।
১৯৫৮-য় একটি শহরের নাম রাখা হয় ওঁর নামে। তুর্কমেনিস্তানেও তাঁর বিস্মকর গ্রহণযোগ্যতা। মুঘল সম্রাট বাবরও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন নাভোইয়ের কীর্তিতে।
কেনাকাটার সবচেয়ে বড় জায়গা ‘চোরসু বাজার’অনেকটা আমাদের নিউ মার্কেটের মতো। তবে তার থেকে অনেক বড় আর সাজানো। শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের তালিকায় আছে তৈমুর লংয়ের স্মৃতিবাহী ‘আমির তৈমুর স্কোয়ার’, ‘হজরত ইমাম কমপ্লেক্স’, ‘মিউজিয়াম অব ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি’, ‘কুকেলদাস মাদ্রাসা’, ‘আবুল কাশিম মাদ্রাসা’ প্রভৃতি। নগর-পরিকল্পনা, মেট্রো রেল থেকে বিভিন্ন ভবনের স্থাপত্য প্রবল ভাবে মনে করিয়ে দেয় রাশিয়ার কথা। সোভিয়েত আমলে তাসখন্দ ছিল গোটা তল্লাটের চতুর্থ বৃহত্তম শহর।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.