মহাকরণের গদিতে দেড় বছরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আশাভঙ্গের সুর। সেই হতাশা এতটাই যে প্রকাশ্যে তিনি মন্তব্য করিয়াছেন, এই রাজ্যকে নিলামে চড়াইলেও কেহ তাহার জন্য দর হাঁকিবে না। সেই সঙ্গে তাঁহার আরও মন্তব্য, এমন দুর্দশার কথা আগে জানিলে তিনি ক্ষমতায় আসার জন্য ব্যস্ত হইতেন না। গভীর, গভীরতম হতাশা হইতেই এ ধরনের হৃদয়বিদারক শোকোক্তি প্রসূত হইতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর হতাশা অকারণও নয়। বাস্তবিকই বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের হাঁড়ির হাল করিয়া গিয়াছে। কেবল অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনাই তো নয়, বামপন্থীদের সাড়ে তিন দশকের অপশাসন যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো, শিল্পায়ন সর্ব দিক হইতেই রাজ্যকে অধঃপাতের অতলে পাঠাইয়া দিয়াছে, তাহাতে দ্বিমত হওয়ার অবকাশ নাই। বস্তুত, বাম জমানার শেষ দিকে এই কারণেই রাজ্যবাসী ডুবন্ত মানুষ যে ভাবে খড়কুটা আঁকড়াইয়া ভাসিয়া থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে, সেই ভাবেই তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেসের বিকল্পকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিলেন।
ভরপুর আশাবাদ নয়, স্বপ্নের ভোর আনিয়া দিবার প্রত্যাশাও নয়, অন্তত সহনযোগ্য বিকল্পের অন্বেষণই রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীকে সে দিন ঘাসফুলের প্রতীকে আকৃষ্ট করে। উত্তরণপর্ব কঠিন হইলেও আশা ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অন্তত আন্তরিক চেষ্টা চালাইবে। কিন্তু বিগত দেড় বছরে দেখা যাইতেছে, যে সকল বিষয়ে বাম জমানায় রাজ্য অধঃপতনের অতলান্তিক গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল, সেই সকল প্রশ্নেই নিমজ্জনের গতি আরও ত্বরান্বিত। দলতন্ত্র সর্ব স্তরের প্রশাসনকে আচ্ছন্ন করিয়াছে, দলের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বও রক্তাক্ত সংঘর্ষে বিস্ফোরিত। জমি-নীতি লইয়া বিভ্রান্তি চরমে। অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ, শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন শিথিল করার সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে। এখন আবার সরকারে ন্যস্ত সামান্য জমিও নিলামে তুলিয়া সর্বোচ্চ দর-হাঁকিয়েদের মধ্যে তাহা ৯৯ বছরের লিজ-চুক্তিতে বিলির সিদ্ধান্ত। শিল্পপতিরা হতাশ, বিমুখ। তোলাবাজিতে সমাজ আনখশির গ্রস্ত। দলদাসরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হইতে হাসপাতাল, সর্বত্র ছড়ি ঘোরাইতেছে। ইহারই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যকে ‘নিলামে তোলা’র মন্তব্য নিশ্চিত ভাবেই শাসক দলের হতাশা আরও বাড়াইয়া তুলিবে। জনসাধারণেরও।
প্রশ্ন উঠিবে, রাজ্যের দুরবস্থার প্রতিকারের আশ্বাস দিয়াই তো তৃণমূল নেত্রী মহাকরণে আসিতে চাহিয়াছিলেন। ভোটদাতাদের কাছে সেই প্রতিবিধানের দায়বদ্ধতা তিনি কি এ ভাবে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারেন? বহুবিজ্ঞাপিত পরিবর্তন-এর দেড় বছরের মধ্যেই রাজ্যকে নিলামে চড়াইবার কথা বলিয়া দায় এড়াইলে চলিবে কেন? দেড় বছর কিন্তু খুব কম সময় নয়, অন্তত শাসকের ঘুরিয়া দাঁড়াইবার অভিপ্রায় বিচারের নিক্তিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের ক্রিয়াকলাপ, কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজ্যবাসী এখনও আশা করার মতো কিছু দেখেন নাই। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও হতাশাগ্রস্ত হইলে অবশ্য রাজধর্ম পালনের দায় হইতে অব্যাহতি চাহিতে পারেন। কিন্তু রাজ্যকে নিলামে চড়াইবার তিনি কে? |