অধিকন্তু ন দোষায়। কোনও কাজ এক জনে করিলে চলে বলিয়াই বাধ্যতামূলক ভাবে তাহা যে এক জনেই করিতে হইবে, এমন কথা নাই। বরং পুরাকাল হইতে উল্টাটাই বলা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, দরকার থাকুক না থাকুক, দশে মিলে কাজ করা অতি বড় সু-অভ্যাস! সেই রীতি মানিয়াই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তেঁতুলপাতায় আরও অনেকের স্থান হইল, মন্ত্রীদের সাহায্যার্থে আরও কিছু বিধায়ককে পরিষদীয় সচিব নামক পদে নিযুক্ত করিবার ব্যবস্থা হইল। বিধানসভায় নূতন বিলের মাধ্যমে পরিষদীয় সচিব পদটি পাশ করাইবার সময় বিরোধীদের যথাবিধি চেঁচামেচি কক্ষত্যাগ কুনাট্যের পাশাপাশি সরকারি মন্ত্রীরা যখন এই বিলের অসীম গুণাগুণ ব্যাখ্যা করিতেছিলেন, এই উপরের যুক্তিটি কিন্তু তাঁহারা দিতে বেমালুম ভুলিয়া গেলেন। অথচ ইহাই তাঁহাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র হইতে পারিত, এ অস্ত্রের কাটান দেওয়া বিরোধীদের পক্ষে কঠিন হইত। যুগব্যাপী যে মহানুভবতার শিক্ষা চলিয়া আসিতেছে, সবাইকে লইয়া চলিবার যে সৎ পরামর্শ পাওয়া গিয়াছে, বর্তমান রাজ্য সরকার যে সেই নৈতিকতার ভূমিতে দৃঢ়প্রোথিত, এই কথাটুকু বলিয়া দিলেই আর গোল থাকিত না। কিন্তু ও পথের বদলে আক্রমণের প্লাবন আটকাইতে মন্ত্রিবর যে কথাগুলি বলিলেন উন্নয়নের কাজে গতি আনিতেই নাকি পরিষদীয় সচিব পদের আমদানি যুক্তি হিসাবে তাহা নেহাতই ফেলনা, দোহাই হিসাবে তাহা নিতান্ত দুর্বল। স্বভাবতই সরকারপক্ষ বিরোধী হম্বিতম্বি থামাইতে পারিলেন না, বিল পাশ হইতে না হইতে রাজ্যপালের নিকটে প্রতিবাদপত্র প্রেরিত হইল!
বিতর্কের আগে প্রতিপক্ষের প্রশ্ন আন্দাজ করিয়া উত্তর প্রস্তুত করা একটি জরুরি কাজ। তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী বা শিল্পমন্ত্রী সে কাজটি সম্ভবত মন দিয়া করেন না। তাই এই যুক্তিপ্রদানের আগে ভাবিলেন না যে, ‘কাজ করিতে হইবে তাই লোক চাই’ এই যুক্তি পেশ করা মাত্রই তিরের ন্যায় উত্থিত হইবে প্রতিপ্রশ্ন, ‘কী কাজ’, এবং সে প্রশ্নের উত্তর তাঁহারা দিতে পারিবেন না। মাসাধিক কালও নহে, একই লক্ষ্যে প্রতিটি মন্ত্রকের জন্য উপদেষ্টাবৃন্দ নিযুক্ত করিয়াছিল রাজ্য সরকার, কিন্তু অতি বড় সরকারি ভক্তও বলিতে পারিবেন না যে কোনও ‘কাজ’ তাহাতে আগাইয়াছে, কিংবা আগাইবার তোড়জোড় চলিতেছে। রাজ্যে উন্নয়নের কাজ দুরন্ত গতিতে ছুটিতে শুরু করার বদলে দ্রুতবেগে পিছাইতে শুরু করিয়াছে। প্রশাসনের হাল করুণতর হইয়াছে। সরকারি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যের নৃত্য জমিয়া উঠিয়াছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা আইনশৃঙ্খলা নানা ক্ষেত্রের একই হাল, সরকার যেন থাকিয়াও নাই। উপদেষ্টারা কী উপদেশ দিলেন, আদৌ দিলেন কি না, কিছুই বোঝা গেল না, তবে এটুকু বোঝা গেল এ রাজ্যে কাজ ঘটাইবার সাধ্য তাঁহাদের নাই। উপদেষ্টারা পারেন নাই। পরিষদীয় সচিবরা আসিলেই পারিবেন: এত বড় অলীক আশায় কি তবে রাজ্যবাসী এ বার বুক বাঁধিবেন?
বুক বাঁধার সমস্যা অনেক, গোড়াতেই গলদ। এই ‘পরিষদীয় সচিব’ পদটি প্রকৃতপক্ষে কী এবং কেন, তাহা পর্যন্ত অজানা। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলিয়াছেন এই পদের সাংবিধানিকতা লইয়া। পদটির পূর্ব-ইতিহাস থাকিলেও সে ইতিহাস কণ্টকহীন নহে। ব্রিটিশ আমলে এই পদ তৈরি হইলেও তাহা বিশেষ ব্যবহৃত হয় নাই। পরবর্তী কালে স্বাধীন দেশে পঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও অসমের বিধানসভা নানা সময়ে এই পদ তৈরি করিলেও শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে তাহা অকার্যকর হইয়াছে। সুতরাং বিধিগত দিকটিও ভাবিবার আছেই। কিন্তু মূল প্রশ্ন তো বিধির নহে, নীতিরও নহে, চক্ষুলজ্জার। কোষাগারে অর্থ নাই, মন্ত্রকে কর্ম নাই, যাত্রাপথের হদিশ নাই, আছে কেবল চক্ষুলজ্জা জলাঞ্জলি দিয়া সরকারি ক্ষমতার বলয়টি যত দূর সম্ভব, যত জন সম্ভব বিস্তৃত করিয়া চলিবার নিরন্তর বাধ্যবাধকতা। সত্যেরে সহজে লওয়া সত্যের পক্ষেও ভাল, শ্রোতার পক্ষেও ভাল। এই কারণেই, কাজের দোহাই না দিয়া, মারপিট ও খেয়োখেয়ির স্বপ্নরাজ্যে খামখা উন্নয়নের বুলিতে লোক না হাসাইয়া, মন্ত্রিবর সে দিন সার কথাটি সোজা বলিলেই পারিতেন। |