অল্প সময়ের মধ্যে কলকাতার পথে-পথে ত্রিফলা (ট্রাইড্যান্ট) আলো বসানোর প্রস্তাবে যে খোদ মেয়রেরই সম্মতি ছিল, পুরসভার নথিতে তা স্পষ্ট হয়ে গেল। দেখা গেল, কলকাতা পুরসভার আলো বিভাগের তদানীন্তন ডিজি এ বিষয়ে যে নোট তৈরি করেছিলেন, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ই তা অনুমোদন করেছেন।
ত্রিফলা-বরাতে অনিয়মের যাবতীয় দায় পুরসভার তৎকালীন ডিজি (আলো) গৌতম পট্টনায়কের ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গৌতমবাবু তখন জানান, তাঁকে পুরসভার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছিলেন খুব তাড়াতাড়ি কাজটি শেষ করতে। তবে সেই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’ কে বা কারা, সে সম্পর্কে গৌতমবাবু মুখ খোলেননি। এ বার পুর-নথিতেই প্রকাশ, ত্রিফলা বসানোর কাজ ‘খুব দ্রুততার সঙ্গে’ সেরে ফেলার নির্দেশে সই করেছিলেন মেয়র শোভনবাবু স্বয়ং। এবং সেই অনুমোদনের কাগজে আলো বিভাগের মেয়র পারিষদ মনজার ইকবালেরও সই রয়েছে। |
দু’দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ত্রিফলা-বিতর্কে তিনি মেয়রের পাশে রয়েছেন। বুধবার রবীন্দ্র সরোবরের এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁরই নির্দেশে পুরো কাজটি ২৩৮ জন ঠিকাদারকে দিয়ে করানো হয়েছিল, এবং তাতে অনিয়ম কিছু হয়নি। যদিও তড়িঘড়ি কাজ শেষ করতে বিনা টেন্ডারে বরাত ও বাজারের বেশি দরে মাল কেনার অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রী এড়িয়ে যান। কিন্তু তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা সংক্রান্ত নির্দেশনামায় মেয়রের অনুমোদন শুক্রবার প্রকাশ্যে আসায় বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। ত্রিফলা প্রসঙ্গে অভ্যন্তরীণ খসড়া রিপোর্টের জেরে পুর-প্রশাসন এমনিতেই চাপে। এই ঘটনায় চাপ আরও বাড়ল বলে পুর-মহলের একাংশ মনে করছে।
ত্রিফলা-প্রকল্প নিয়ে গৌতমবাবুর নোটে প্রস্তাব ছিল, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে বিভাগের নোটিস বোর্ডে স্পট এবং শর্ট টেন্ডার ডাকা হোক। আরও রাস্তায় ত্রিফলা আলো বসানোর প্রস্তাব দিয়ে বাড়তি ১১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকার মঞ্জুরি চাওয়া হয়েছিল। গত ২ মার্চের ওই নোটে গৌতমবাবু জানিয়েছিলেন, ইতিমধ্যে ২৮টি রাস্তায় ত্রিফলা লাগানো হয়ে গিয়েছে, ২৭টি রাস্তায় কাজ চলছে, ১৪টিতে শুরু হয়নি। দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ নোটে সই করেছেন মেয়র পারিষদ। আর মেয়র সই করেছেন ২১ মার্চ তারিখে।
এ বার কি মেয়র দায় নেবেন?
শোভনবাবুর কথায় অবশ্য তেমন আভাস নেই। তাঁর ব্যাখ্যা, “অনেক কাগজই তো সই করার জন্য আসে। বিশ্বাস করে সই করে দিই।” মেয়রের দাবি, “আমি সই করেছি গত ২১ মার্চ। তার আগেই কাজ শুরু হয়েছিল। পরে আমার কাছে নোট আসে, আমিও সই করে দিই।” আলো বিভাগের তথ্যও বলছে, নোট সইয়ের আগেই ৩০ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার অনুমতি কে দিয়েছিল?
এ প্রসঙ্গে পুর-কর্তাদের মুখে কুলুপ। পুর-প্রশাসনের একাংশের দাবি: ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মৌখিক বা লিখিত অনুমতি ছাড়া কাজে নামার প্রশ্নই ওঠে না। সেই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’টি কে, তা নিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছে পুরসভার বিরোধীরা। নোটে তাঁর সই সম্পর্কে মেয়র পারিষদ (আলো)-র কী বক্তব্য?
মনজার ইকবালের জবাব, “মনেই করতে পারছি না! ন’মাস আগের কথা! কাগজ দেখতে হবে।”
তবে ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ সিদ্ধান্তের বলি অফিসারদের কেন হতে হচ্ছে, পুর-প্রশাসনের অন্দরে এখন সেই প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দিন কয়েক আগে পুরসভার ডিজি পদমর্যাদার ১১ জন অফিসার মেয়রের কাছে দরবারও করে এসেছেন। এ দিন তাঁদের এক জন বলেন, “আমরা মেয়রকে বলেছিলাম, উপরওয়ালার অনুমোদন না-থাকলে কোনও অফিসার নিয়ম ভাঙতে পারেন না। ওই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কে, আমরা তখনই জানতাম। গৌতমবাবুর নোটে মেয়রের সই আমাদের সন্দেহকেই মান্যতা দিচ্ছে।” অফিসাটি জানান, যে কোনও কাজে টেন্ডার আবশ্যিক। এ জন্য পুরসভার টেন্ডার-বার্তা, ওয়েব পোর্টাল ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। গড়তে হয় টেন্ডার কমিটি, ওয়ার্ক কমিটি। ত্রিফলায় এর কিছুই মানা হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ। “যে ভাবে ২৩৮ জন ঠিকাদারের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, এবং সেই সুযোগে নোটিস বোর্ডে স্পট টেন্ডার ও শর্ট টেন্ডার ডেকে কাজ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়মবিরুদ্ধ।” মন্তব্য করেন তিনি।
এ দিকে পুর-সূত্রের খবর: অভ্যন্তরীন খসড়া অডিট রিপোর্টে ত্রিফলা-কাণ্ড নিয়ে যে সব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, পুর-কর্তৃপক্ষের তরফে এ দিন তার জবাব সংশ্লিষ্ট অডিট সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে। |