চাঁদ ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েছিল রাজবাড়ির শীর্ষে। কত লক্ষকোটি বছর ধরে ঘুরতে থাকা চাঁদ তার পরিক্রমণে এই অবসরটুকু নিচ্ছে গত ২০০ বছর ধরে। এই সময়কালে রাজপ্রাসাদের স্থানান্তকরণ ঘটেছে কয়েক বার। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছেন গৃহদেবতা মদনমোহন কৃষ্ণ। কোচবিহারের প্রাণের ঠাকুর। তাঁরই রাসযাত্রাকে কেন্দ্র করে ২০০ বছরের এই মিলনোৎসব।
মিলনদর্শী চাঁদ যখন একটু দাঁড়ায়, দেখে সুপ্রাচীন কোচবিহার অঞ্চলের নবতর রূপ, তখন কুয়াশা নামে দেবদেউলের মাথার ওপর। গাছের পাতায়, ঘাসে ঘাসে। মণ্ডা-মিঠাই-জিলিপির দোকানের উনুনে আঁচ পড়ে। প্যাঁচ কষানোর রসদ প্রস্তুত। বড় কড়ায় বগবগিয়ে ফোটানো তেলে আড়াই প্যাঁচের অসামান্য শিল্প ভেজে উঠলেই তাকে ফেলা হয় রসের কড়ায়। প্রতিবারের মত এ বারেও ব্যতিক্রম নেই জিভে জল আনা জিলিপির প্রতি আগ্রহে। তার ওপর এ বারের বিশেষত্ব যে ২০০ লেখা জিলিপি, তার উদ্ভাবন অবিস্মরণীয়। প্যাঁচ প্রিয় বাঙালির রসবোধও যে কম প্যাঁচালো নয়, রাসমেলায় জিলিপি আস্বাদনের ভিড়ে তার প্রমাণ লোকের হাতে হাতে। এমনই তার জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে জিলিপির কথা ভাবতে পারেন। |
মেলার মূল প্রবেশপথেই এমন বিপুল লোভনীয় জিলিপি সম্ভার যে এ ছেড়ে আর এগোনোই রীতিমতো আত্মসংযম। এ ছাড়া মুরগির কোর্মা, পটলের দোর্মা, প্যারিসের ছেঁচকি থেকে পুলি-পাটিসাপটার অনন্ত হাতছানি। আগে বাখরখানি লুচি এখানে খ্যাতনামা ছিল, এখন সে জায়গায় বাটাটা পুরি। তাতে কী? জিভে জল আনা এমন সব খাবারের প্রতি আপাত বৈরাগ্য নিয়ে মদনমোহন দেবতার সঙ্গে দেখা করার প্রাথমিক কর্তব্যের পথে চলা যেন মেনকার উল্লোল বিভঙ্গ উপেক্ষা করে ঋষি বিশ্বামিত্রর ধ্যানমগ্নতার প্রচেষ্টা!
তবে, ভারী সুশৃঙ্খল এ দেবদর্শন। ভিড় আছে, ভারী ভদ্রসভ্য। বাঁধভাঙা নবযৌবনদূত এবং বিদ্যুৎলতা তরুণীরা সংস্কৃতি মঞ্চ ঘিরে উচ্ছ্বসিত। তবু সে আবেগ, কোচবিহারের পরিশীলিত সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর মদনমোহনবাড়ির কথা কী বলব! উঁচু মঞ্চে, মৃদু হাসি মুখে মেখে স্বয়ং দর্শন দিচ্ছেন নারায়ণ, আমাদের প্রাণকেষ্ট, মদনমোহন। সাদা মন্দিরের গায়ে আলো পড়ে উদ্ভাসিত। ছোট ছোট পুতুলের বলা পৌরাণিক গল্পকথা। এমনকী বিপুলাকায় পুতনা রাক্ষসীও এখানে নির্মিত হতে পেরে ধন্য মনে হয়। তার অদূরেই রাসদণ্ড। যেন মহরমের তাজিয়া শ্বেতশুভ্র রূপে। পুণ্যার্থীর স্পর্শে ক্রমাগত ঘূর্ণায়মান। মানুষের সঞ্চিত পুণ্যবলে সমৃদ্ধ হবে কোচবিহার অঞ্চল। উর্বর হবে কৃষিক্ষেত্র। বৈরাগী দিঘির ওপর যত অন্ধকার, দূরীভূত হবে। এই প্রার্থনা সর্বজনীন। এমনকী ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মানবিক দয়ার প্রতীক্ষায় মন্দিরদ্বারে অপেক্ষারত যারা, তাদেরও একই বচন। পুণ্য হোক। মঙ্গল হোক।
পুণ্যক্ষেত্রের ঠিক বাইরেই, যাকে বলে ফুচকাধাম। মশলার গন্ধের ম-ম বিস্তারে মিশে যাচ্ছে যুবক ফুচকাওয়ালার হাস্যময় রসবোধ। ‘মসলা ভাল করে মেখেছো তো?’ জবাবে সে বলে, ‘যেমন মাখান, তেমন মাখি।’ দিব্য সেই ফুচকার স্বাদ। প্যাঁচালো রসালো জিলিপি আর ফুচকাষোলো আনা বাংলা সংস্কৃতি স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত এই কোচবিহার রাসমেলায়। সেই সঙ্গে মিলনধর্মে সে জড়িয়েছে পরিপার্শ্বকে। সংস্কৃতির মঞ্চে বিহু গান পরিবেশন করছেন অসমীয় শিল্পী। সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছেন আফ্রিকান ক্রীড়াকুশলী। মুম্বইয়ের, কলকাতার গায়ক এসে মাতিয়ে তুলছেন মেলা। বাংলাদেশের নোনা ইলিশ, শাড়ি, মেলামাইনের বাসনকোসন, মণিপুরের বাঁশের কাজ, সারা পশ্চিমবাংলার কাঠ, বাঁশ, পাট শিল্পের সম্ভার। লোক আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে। বাখরখানি লুচির কালে হয়তো সম্বল ছিল হাঁটাপথ, গরুরগাড়ি। কষ্ট ছিল। এখন পাকা সড়ক অনেক বেশি। অটো আছে। বাস আছে। তবু কষ্ট আছে। কারণ, সড়ক ভাঙা, খানাখন্দময় গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে। আর কোচবিহারের রাসমেলায় সমগ্র উত্তর বাংলার সমাবেশ।
ঠিক দশটায় বন্ধ করে দেওয়া হয় মেলার সব উচ্চগ্রাম যন্ত্র। ঠিক এগারোটায় দোকানপাটের ঝাঁপ পড়ে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো জাগ্রত থাকে মদনমোহন মন্দির। রাসচক্র ঘোরে। এ চক্রের নির্মাতা আলতাফ মিয়া। বংশ পারম্পর্যে তিনি এ নির্মাণের অধিকারী। রাসদণ্ডের শিল্প এবং তাকে ঘুরিয়ে পুণ্যার্জনের রীতি বৌদ্ধ যন্ত্রমের সদৃশ। এখানেই রাসমেলার মহৎ বৈশিষ্ট্য। ২০০ বছর ধরে সর্বময় ব্যাপ্তিতে নানা ধর্ম সংস্কৃতি জাতি ভাষাকে মিলিয়ে দিয়েছে কোচবিহার। এক ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন সুনির্মিত নগর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কাছে যা প্রাপ্য ছিল কোচবিহারের, তার প্রায় কিছুই পাওয়া হয়নি। উত্তর পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলি এবং বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হওয়ায় এ শহর হতে পারত অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র, প্রাকৃতিক শোভা এবং ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সমৃদ্ধ হওয়ায় পেতে পারত অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রের মর্যাদা। সে পেতেই পারে একটি সচল বিমানপোত, আস্ত সড়ক, আরও কয়েকটি মেল ট্রেন, সুন্দর নিকাশি ব্যবস্থা। তার বিশাল দিঘিগুলি, তার বিল, ঝিল, জলাশয়গুলি আবার হয়ে উঠবে স্বচ্ছ, সুন্দর, পরিযায়ী পাখিরা আবার উড়ে আসবে এ নগরে - এমন আশাও সে করতেই পারে। রাসচক্রের সর্বধর্মসমন্বয়ী পুণ্য কোচবিহারকে দিক সেই প্রার্থিত সম্মান। সমৃদ্ধি। |