বলে গেলেন জার্মান রাষ্ট্রদূত
লগ্নি টানতে সাজিয়ে তুলতে হয় নিজেকে
মন্ত্রিত অতিথি যেমন গৃহস্থের বাড়িতে পা দিয়েই বুঝতে পারেন তাঁর কদর কতটুকু, বিনিয়োগের ব্যাপারটাও ঠিক তেমন বলেই মনে করেন মাইকেল স্টাইনার। ভারতে জার্মান রাষ্ট্রদূত। পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু শিল্প আনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক কতটা আন্তরিক, সে ব্যাপারে বেশ খানিকটা ধন্দ নিয়েই ফিরে গেলেন তিনি।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এখন আর্থিক মন্দায় জর্জরিত। জার্মানি কিন্তু ব্যতিক্রম। তারা বিনিয়োগের ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। চিনে ইতিমধ্যেই তাদের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। এখন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করছে তারা। নজর পড়েছে ভারতের দিকেও। মুম্বই, বেঙ্গালুরু ঘুরে কলকাতায় এসেছিলেন স্টাইনার। বিনিয়োগের উদ্দেশ্য নিয়েই। কিন্তু রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ধারণা হল? আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে আশাব্যঞ্জক কিছু শোনাতে পারলেন না স্টাইনার। শুধু বললেন, “মাচ টু বি ডান, অনেকটা পথ চলা বাকি।”
জার্মান দূত মাইকেল স্টাইনার। —নিজস্ব চিত্র
বিনিয়োগের জন্য নানা দেশ, নানা রাজ্যে ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে স্টাইনারের। সেই অভিজ্ঞতাই বলছে, “ছবিটা অনেকটা সুন্দরী প্রতিযোগিতার মঞ্চের মতো। সৌন্দর্যের মুকুট ছিনিয়ে নিতে প্রতিযোগীরা যে ভাবে সেজেগুজে নিজেদের মেলে ধরেন, বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য প্রতিটি দেশ, প্রতিটি রাজ্য ঠিক ওই ভাবে নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রস্তুত করছে।” সেই প্রস্তুতি শুধু জমি-নীতি বা পরিকাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শিল্পবান্ধব পরিবেশ, পারস্পরিক আস্থার আবহ গড়ে তোলাটাও খুব জরুরি। এই প্রসঙ্গে স্টাইনারের বক্তব্য, “নিমন্ত্রণ-বাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনি অনুভব করতে পারেন, সেখানে আপনার কদর কতটুকু। শিল্পের ক্ষেত্রেও তাই। শিল্প-সহায়ক পরিবেশ থাকলে ডাকতে হবে না, বিনিয়োগকারীরাই এগিয়ে আসবেন।”
সেই কদর, সেই পরিবেশ এ রাজ্যে আছে কি? জমি-নীতি, পরিকাঠামোর অভাব, রাজনৈতিক জুলুমবাজি-সহ নানা সমস্যা নিয়ে বারবারই সরব হয়েছে রাজ্যের শিল্পমহল। সরকারের শিল্প-নীতির মধ্যেই স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে শিল্প-কর্তাদের অনেকেরই দাবি। স্টাইনার নিজে সোমবার মহাকরণে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। জানা গিয়েছে, জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মুখ্যমন্ত্রী কখনও ড্রয়ার টেনেছেন, কখনও বেল বাজিয়েছেন। কখনও অন্য কাউকে ডেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন স্টাইনারকে। জানা গিয়েছে, মমতা স্টাইনারের সঙ্গে যেটুকু কথা বলেছেন তার সিংহভাগ জুড়েই ছিল রাজ্যের বিরোধী দল এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে বিষোদগার।
উন্নয়নের প্রশ্নে কর্নাটক-মহারাষ্ট্র-গুজরাতের মতো রাজ্যে যেখানে শাসক এবং বিরোধী একজোট হয়ে শিল্পের জন্য দরবার করছে, তখন বিরোধীদের সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাব প্রকারান্তরে নেতিবাচক বলেই মনে হয়েছে তাঁর। গুজরাতে উন্নয়নের প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদী আর আহমেদ পটেল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেন না। এ রাজ্যে সেই দস্তুর দেখতে পাননি স্টাইনার।
আর বিরোধী দল? তাদের সম্পর্কে কী ধারণা রাষ্ট্রদূতের? সিপিএমের সদর দফতরেও গিয়েছিলেন তিনি। দেওয়ালে টাঙানো বাম-মনীষীদের সারি সারি ছবি। স্টাইনার ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, আলিমুদ্দিনকে দেখে পুরনো জাদুঘর ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি তাঁর।
স্টাইনার বারবার বলছেন, শিল্পপতিরা এখন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। তাঁদের বিশ্বাস আর আস্থা অর্জন করাটা জরুরি। রাষ্ট্রদূত বলেন, “পশ্চিমবঙ্গকে সেটাই অর্জন করতে হবে। যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সেই মানচিত্রের বাইরে নয়। ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কর্নাটক সবাই একই পথে হাঁটছে।” এ কথা কি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে পেরেছেন তিনি? স্টাইনার বলেন, “অনেকটাই বলেছি। সুন্দরী প্রতিযোগিতার উদাহরণটাও দিয়েছি। উনি দিল্লি গিয়ে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমার মনে হয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গেও কথা বলা উচিত।” খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ-এর বিষয়টি ‘অভ্যন্তরীণ’। তাই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি স্টাইনার। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক কী ধরনের শিল্প চাইছে, তাঁদের শিল্প-নীতি কী স্টাইনারের মতে সেই বিষয়ে বিশ্বের কাছে বার্তাটা পরিষ্কার হতে হবে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার তো জমি অধিগ্রহণ করতে নারাজ। তা হলে কী করে শিল্প হবে? জার্মানি থেকে কোনও সংস্থা এসে কি সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে জমি কিনবে? স্টাইনারের উত্তর, “বিদেশি কোনও সংস্থার পক্ষে সরাসরি জমি কিনে শিল্প-স্থাপন সম্ভব নয়। কোনও না কোনও ভাবে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।” তবে স্টাইনার মেনে নিচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে জমির চরিত্র অন্য জায়গার চেয়ে আলাদা। “এখানে একে তো জমির পরিমাণ কম। তার উপরে বেশির ভাগ জমিই উচ্চ-ফলনশীল। ফলে দুম করে শিল্পের জন্য সেই জমি অধিগ্রহণ করাটা মুশকিল।” সুতরাং শিল্প ও ফলনশীল জমির মাঝখানে একটি ভারসাম্য তৈরি করা প্রয়োজন। ল্যান্ড-ব্যাঙ্ক তৈরি করাটা এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের তরফে একটা সদর্থক মানসিকতা বলেই ধরা উচিত বলে মনে করেন স্টাইনার।
কিন্তু জমি সমস্যার পাশাপাশি এ রাজ্যে শিল্প-স্থাপনের সময়ে রাজনৈতিক চাপ বড় সমস্যা বলে অভিযোগ। নেতাদের পছন্দ মতো কর্মী ও কাঁচামাল নেওয়ার জন্য জোরাজুরির অভিযোগ অহরহ শোনা যায়। স্টাইনারের কথায়, “এ সমস্তই শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে বাধা। রাজ্য সরকার যদি চায় শিল্প হোক, তা হলে এই সব সমস্যা তাদেরই মেটাতে হবে।” সমস্যা মেটাতে কতটা আগ্রহী সরকার? প্রশ্ন তা নিয়েই। ঘনিষ্ঠ মহলে হতাশা গোপন রাখেননি স্টাইনার। বেঙ্গালুরু-মুম্বই ঘুরে এসেছিলেন কলকাতায়। শিল্পের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেই বেশ পিছিয়ে রয়েছে এ রাজ্য, সেটাই দেখলেন তিনি। শাসক এবং বিরোধী, দু’পক্ষেরই নেতিবাচক মনোভাব যে এর জন্য দায়ী, সেটাও বলে গেলেন! “মাচ টু বি ডান!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.