মামলায় কম সাজার জন্য আপোসের (প্লি বার্গেনিং) আবেদনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে অন্য নানা বিষয়ে ‘এগিয়ে থাকা’ জেলা বর্ধমান। সম্প্রতি একটি আলোচনাচক্রে জেলার গ্রামীণ এলাকার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা নিজেই বলেন, “ইতিমধ্যে রাজ্যের সমস্ত জেলায় প্লি বার্গেনিং শুরু হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরে এ ভাবে সাতটি মামলার মীমাংসা হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে মীমাংসা হয়েছে আটটি মামলার। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা মাত্র পাঁচটি মামলা চিহ্নিত করতে পেরেছি, যেগুলি প্লি বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে মীমাংসা করা সম্ভব।”
গত সোমবার বর্ধমানে ওই আলোচনাচক্রে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত দুই জেলা জজ আশিস সেনাপতি ও সুভাষ কর-সহ বেশ কয়েক জন বিচারক। জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সুব্রত হাটি-সহ বেশ কয়েকজন আইনজীবীও ছিলেন। আলোচনায় উঠে আসে, আদালতগুলির উপরে মামলার পাহাড়প্রমাণ চাপ কমাতে গত ২০০৬ সালের ৫ জুলাই থেকে নয়া আইন চালু করে রাজ্য সরকার। কিন্তু এখনও রাজ্যের বিভিন্ন জেলার আদালতে ওই আইন মোতাবেক প্লি বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে মামলার মীমাংসা চালু করা সম্ভব হয়নি।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিচারকেরা জানান, এ ভাবে যে আদালতের আওতাতেও দায়ের হওয়া মামলার আপোস-মীমাংসা সম্ভব, তা এখনও অনেকেরই জানা নেই। এ নিয়ে প্রচারের প্রয়োজন। প্রয়োজনে সংশোধানাগারগুলিতে গিয়ে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন বন্দিদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ‘প্লি বার্গেনিং’ আদতে কী?
পুলিশ সুপার জানান, যে সব মানুষ অনিচ্ছাকৃত বা উত্তেজনার মাথায় অপরাধ করে জেলে রয়েছেন, অপরাধের গুরুত্ব তুলনায় কম যাতে সর্বাধিক সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে, তাঁরাই এই ভাবে মীমাংসার মাধ্যমে সাজা কমানোর আর্জি জানাতে পারেন। যে সব অভিযুক্তের অপরাধের তদন্ত করে পুলিশ চার্জশিট পেশ করেছে এবং তার ভিত্তিতে যাঁদের বিচার শুরু হয়ে গিয়েছে, সেই ধরনের অপরাধীরাই এই সুযোগ নিতে পারেন।
কী ভাবে এই সুযোগ নেবেন আসামি?
পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, অভিযুক্তকে বিচারকের কাছে করা দরখাস্তে নিজের অপরাধ কবুল করে ‘প্লি বার্গেনিং’-এর সুযোগ চাইতে হবে। বিচারক যদি দরখাস্ত পরীক্ষা করে বোঝেন, তা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় করা হয়েছে, তিনি অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী বা অভিযুক্তের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তকে ডাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বিচারকের নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি থাকবেন। এই পথে শুধু আদালতগুলির উপর চাপ কমবে না, কারাগারগুলিতেও ভিড় কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু আলোচনাচক্রেই এই পদ্ধতির সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। আইনজীবী রামেন্দ্রসুন্দর মণ্ডলের মতে, “এই পথে শুধু অর্থবান ব্যক্তিরাই সাজা মকুবের ক্ষেত্রে আদালতের সাহায্য পেতে পারেন।” আইনজীবী আজিজুল হক মণ্ডলের প্রশ্ন, “এ ভাবে সাজা মকুবের সুযোগ কি সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়াতে সাহায্য করবে না?” অনেক আইনজীবীর আশঙ্কা, এ ভাবে মামলার আপোস-মীমাংসা হয়ে গেলে তা আইনজীবীদের ব্যবসার পক্ষে ক্ষতিকর হবে।
তবে বর্ধমান যে এই আইনের প্রয়োগে পিছিয়ে পড়েছে, সভায় উপস্থিত বিচারকেরা তা মানতে চাননি। চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা জজ আশিস সেনাপতি বলেন, “আমাদের বিভিন্ন আদালতে বেশ কিছু মামলার মীমাংসা প্লি বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে ঘটেছে। তার সব তথ্য পুলিশের কাছে নেই।” তবে তেমন মামলার সংখ্যা ঠিক কত, তা তিনি জানাননি। জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সুব্রত হাটির পাল্টা প্রশ্ন, “এই তো সবে সোমবার সভা করে এই পথে মামলাগুলির মীমাংসার কথা বলা হয়েছে। তার আগে কী করে প্লি বার্গেনিংয়ের মাধ্যমে মামলার মীমাংসা হবে?” পুলিশ সুপার বলেন, “প্রতিটি থানা স্তরে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আলোচনায় ডেকে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হবে।” |