বালুরঘাটে ছোটদের নাটক হয় না কেন? |
সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি বালুরঘাট সংস্কৃতির শহর। নাটকের শহর। বর্তমানে আবার উত্তরবঙ্গ নাট্য অ্যাকাদেমির প্রধান শহর। নাটকের সব ক’টি শাখায় সেই শহর স্বাভাবিক ভাবে পথ দেখানোর দায়িত্বে। সত্তর বা আশির দশকে বালুরঘাটের নাটক যেমন শহর, জেলা সীমানা ছাড়িয়ে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, মাঝের বেশ কিছু বছরের নির্জলা সময় কাটিয়ে বালুরঘাটে আবার নাটকের খাতে জল বইতে শুরু করেছে সাম্প্রতিক কালে। সেই সময় বা এই সময়, কোনও সময়েই বালুরঘাটে শিশুনাটক অথবা ছোটদের নাটক নিয়ে সেই অর্থে ভাবনা-চিন্তা হয়নি। শহরের যে নাট্যদলগুলি নাট্যপথে ক্রমশ পরিচিত করেছে নিজেদের, তারা কখনওই ছোটদের উপর বিনিয়োগ করেনি। কেন? ছোটদের নাটকচর্চা নিজেদের পরিচয় বাড়ানোরে ক্ষেত্রে মাইলেজ দিতে পারবে না, সেই জন্যে? সেই জন্যই কি এই নিরাপদ নাটক নাটক খেলার আয়োজন?
নাট্যমন্দির, বালুরঘাট নাট্যকর্মী, নাট্যতীর্থ, সমবেত নাট্যকর্মী, ত্রিতীর্থ, সৃজন, শপথ-এর নাট্যভাবনা শুধুই বড়দের দ্বারা, বড়দের জন্য ভাবিত হয়, সেখানে ছোটদের স্থান কোথায়? বালুরঘাটে ছোটদের নাটক বলতে কখনও বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘যদি এমন হত’, কাটাবাড়ি আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘স্বপন’, অযোধ্যা কে ডি বিদ্যানিকেতনের ‘লড়তে হবে একসাথে’, চকভৃগু নবপ্রভাত সংঘের ‘ডাকঘর’, বিজয়া সম্মিলনীতে দিশারী ক্লাবের ‘বোধন’, ‘দেবলোক ডট কম’, ‘চালচিত্র’, ‘উমা এল ঘরে’, আবার কখনও বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী-উৎসাহী শিক্ষকের আন্তরিকতায় পনেরো-কুড়ি-আধ ঘণ্টার নাটক। ব্যস। তারপর বড়সড় একটা ‘শূন্য’। অথচ আমরা জানি ছোটরাই ভবিষ্যৎ। এও নিশ্চিত জানি ছোটরাও সমাজেরই অংশ। নাটকের যখন স্বর্ণালী সময় কিংবা এখন যখন বালুরঘাটের নাটকের জেগে ওঠার সময়, সেই সময়ে বারবার ছোটরা কীভাবে বাদ হয়ে যাচ্ছে? কলকাতার ‘নান্দীকার’, বিডন স্ট্রিটের শুভম, সাম্প্রতিক নয়ে নাটুয়ার কথা বাদ দিলাম, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহর বা আধা শহরেও ছোটদের নাটকের চর্চা আছে, ছোটদের নাটক নিয়ে বিস্তর চিন্তা-ভাবনা চলছে, তখনও কীভাবে ব্যতিক্রম থাকে এই শহর? এই শহর না নাটকের শহর!
গ্রীষ্মাবকাশ া পূজাবকাশের অবসরে একদমই কি সম্ভব নয় কর্মশালা ভিত্তিক প্রযোজনা? বর্তমান সময় ও অভিভাবকদের মানসিকতা যদি প্রতিবন্ধকতা হয়, তাহলে অন্যরা পারছে কী করে? সত্যি সত্যিই যদি বালুরঘাট নাটকের শহর হয় এ ক্ষেত্রে দশ গোল দেবে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, কালিয়াগঞ্জ? কলকাতা এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে পড়াশোনা, কর্মসূত্র, ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের পরিধি আমাকে জানিয়েছে নাটকের এই বিভাগে বালুরঘাট কয়েক শো যোজন পিছিয়ে। বড়দের নাটকের সাপ্লাই লাইন হিসেবেও শিশু-কিশোররাই অটোমেটিক চয়েসএ কথা কী করে ভুলে যান বালুরঘাটের নাট্য-নির্দেশকরা?
চেষ্টা যে একদমই হয়নি, তা নয়। কিন্তু তা বোধহয় দশমিক অংশও নয়। আর সে কারণেই ছোটদের নাট্যচর্চা নাটকের শহরে অঙ্কুরিত হয়নি বলা যায়। এই শহরে বিদ্যালয় শিশু নাট্য উৎসব, শিশু-কিশোর নাট্য উৎসব কিংবা নিদেন পক্ষে আন্তঃবিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতা হতে পারে না? নাট্যদলগুলি উদ্যোগী হতে পারে না এ নিয়ে? তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর সহযোগী হতে পারে না এই প্রাসঙ্গিক পদক্ষেপের? নেহরু চিলড্রেনস মিউজিয়ামের ‘ভাঙ্গা বুকের পাজরে’, ‘লুক্সেমবার্গের লক্ষ্মী’, ‘একলা পাগল’ ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক কি আমাদের এখানকার ছোটরা করতে পারে না? তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস কি আমাদের নাট্য-নির্দেশকদের নেই? নাকি নতুন এক্সপেরিমেন্টে পিছলে যাবার ভয়? মরচে পড়ল নাকি সৃজন কর্মকুশলতায়? বালুরঘাট ‘সানাই’ দেখেনি! নাট্যবোদ্ধারা কি এর পরও চুপচাপ বসে থাকবেন? রাতের ঘুম কি একটুও নষ্ট হবে না? বালুরঘাটের শিশু-কিশোরদের নাটক নিয়ে আর গর্বিত হওয়ার সুযোগ কি হবে না বালুরঘাটবাসীর? কোথাও কি কোনও আলো নেই?
তুহিনশুভ্র মণ্ডল, বেলতলা পার্ক, বালুরঘাট |