নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আরও ঘনীভূত হল তৃণমূলের শোভনদেব-সঙ্কট! দলেরই অনুগামী কর্মী সংগঠনের হাতে নিগ্রহের ঘটনায় বিচার না-পেয়ে ক্ষুব্ধ শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ফের প্রকাশ্যে সরব হলেন। অভিযোগ করলেন, তৃণমূলে নতুন যোগ-দেওয়া একটি অংশ তোলাবাজি, সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছে। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিপদ সম্পর্কে সম্যক অবহিত। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল তাঁকে ঘিরে রেখেছে! শোভনদেববাবুর এই নতুন তোপের জেরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। ফলে দলীয় নেতৃত্বের তরফে শোভনদেব-ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার সম্ভাবনাও আপাতত ক্ষীণ হয়ে পড়ল। বরং, দলের ভিতরেই দাবি উঠতে শুরু করল, সরকারি মুখ্য সচেতকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক শোভনদেববাবুকে!
সম্প্রতি দলের নেতা-বিধায়কদের এসএমএস পাঠিয়ে দলীয় বিষয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সামনে মুখ খুলতে নিষেধ করেছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের নির্দেশ মেনে শোভনদেববাবুও গত কয়েক দিনে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু রবিবার নিজের বিধানসভা কেন্দ্র রাসবিহারীতে দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র সভা থেকে তৃণমূলের অন্দরের ব্যাপারে ফের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি। দলের একাংশের মতে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনস্থার ঘটনায় মমতা-সহ তৃণমূল নেতৃত্বের থেকে সুবিচার না পেয়েই শ্রমিক সংগঠনের মঞ্চকে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছেন শোভনদেববাবু। |
দলনেত্রী বারবার বলছেন, কাট মানি নেবেন না।
সিন্ডিকেট করবেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সব
ঘটনা ঘটছে। স্বার্থান্বেষী কিছু লোক তাঁকে ঘিরে রেখেছে!
শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় |
|
|
নিগৃহীত হওয়ার পরে শোভনদেববাবুকে এক দিন তৃণমূল ভবনে ডেকে পাঠিয়েও বৈঠক বাতিল করেছিলেন দলীয় নেতৃত্ব। এর পরে কালীঘাটের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকলেও মমতার সাক্ষাৎ পাননি এই বর্ষীয়ান নেতা। মমতা তাঁকে ফোনে আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া সফর সেরে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু নেত্রীর কাছ থেকে আর ডাক পাননি তিনি। এর মাঝে এক দিন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেও শোভনদেববাবুর প্রতি দলের উপেক্ষা যথেষ্টই স্পষ্ট ছিল। দলের অনেকেই মনে করছেন, শোভনদেববাবুর এ দিনের বক্তব্যে এ সবের বিরুদ্ধে ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
শ্রমিক সংগঠনের সভায় শোভনদেববাবু জানান, তৃণমূলের আগাগোড়া অনুগত সৈনিক হিসেবে কিছু সম্মান তাঁরা প্রত্যাশা করেন। কিন্তু এখন দলে নতুন যাঁরা আসছেন, তাঁদেরই পদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে! তাঁর কথায়, “দলনেত্রী বারবার বলছেন, কাট মানি নেবেন না। সিন্ডিকেট করবেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সব ঘটনা ঘটছে। দলনেত্রী এগুলো জানেন বলেই বারবার সতর্ক করছেন। স্বার্থান্বেষী কিছু লোক তাঁকে ঘিরে রেখেছে!” একই সঙ্গে রাসবিহারীর প্রবীণ বিধায়কের মন্তব্য, “তৃণমূলের দুঃসময়ে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কোনও কদর নেই! নতুন যাঁরা আসছেন, পদ পাচ্ছেন। কেউ বিপ্লবী সাজছেন!”
দলে নবাগত এবং পুরনো সৈনিকদের মধ্যে ফারাক বোঝাতে বট ও লাউগাছের উদাহরণ দেন তৃণমূলের প্রথম বিধায়ক। তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, পূর্ণেন্দু বসু-দোলা সেনের মতো যাঁরা পরে দলে এসে মমতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, নাম না-করে তাঁদের দিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন শোভনদেববাবু। পরে ঘনিষ্ঠ মহলে শোভনদেববাবু জানান, তোলা বা সিন্ডিকেট নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা তৃণমূল নেত্রীর নানা সময়ে উচ্চারিত সতর্ক-বাণীর পুনরাবৃত্তি মাত্র।
মুখ খোলার ব্যাপারে দল ফতোয়া জারি করার ক’দিনের মধ্যেই প্রবীণ বিধায়কের এ দিনের বক্তব্যে আলোড়িত তৃণমূলের অন্দরমহল। নেতৃত্বের নির্দেশ সত্ত্বেও শোভনদেববাবু কেন প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করে অস্বস্তি বাড়ালেন, তা নিয়ে সরব তৃণমূলের একাংশ। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “আমরা সমস্যা সামাল দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। শোভনদেববাবুকেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, এই সময়ে মুখ বন্ধ রাখতে। তা সত্ত্বেও এই কাজ করে উনি ঠিক করলেন না!” দলের একাংশ এমন দাবিও তুলতে শুরু করেছে, সরকারি মুখ্য সচেতকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক শোভনদেববাবুকে। পার্থবাবু অবশ্য এ দিন বলেছেন, “পরিষদীয় মন্ত্রী হিসেবে আমার এখনও কিছু জানা নেই।” বিধানসভার অধিবেশন চলছে। এখন শোভনদেববাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বিধানসভার ভিতরে তার প্রভাব পড়বে কি না, তা-ও মাথায় রাখতে হচ্ছে। তবে গোটা ঘটনায় দলীয় নেতৃত্বের সঙ্কট মোচনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “বোঝাই যাচ্ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহের ঘটনার নিন্দা করলেই দলীয় নেতৃত্ব সঙ্কট সামাল দিতে পারতেন। অথচ ঘটনার নিন্দা না-করে সমস্যাটা জিইয়ে রাখা হল!” |