বত্রিশ বছর আগের এক বড় ম্যাচে মৃত্যুমিছিল দেখেছিল ইডেন। সেই ভয়াবহতার পুনরাবৃত্তি থেকে কোনও মতে রক্ষা পেল রবিবারের যুবভারতী। আর এক ডার্বিতে।
১৯৮০-র ১৬ অগস্ট পায়ের চাপে মৃত্যু হয় ১৬ দর্শকের। ২০১২-র ৯ ডিসেম্বর আই লিগের প্রথম ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে বিরতির সামান্য আগে-পরে যা যা ঘটল, তা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। ওকোলি ওডাফা লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যেতেই গ্যালারি থেকে ছোড়া ইটের আঘাতে মোহন মিডিও রহিম নবি রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। কার্যত এর পরই রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে যুবভারতী। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নবির ঘটনাকে ঢাল করেই বিরতির পর টিম তুলে নেয় মোহনবাগান। ফলে ভেস্তে যায় ম্যাচ।
এতিহাদ স্টেডিয়ামেও এ দিন ছিল ম্যাঞ্চেস্টার ডার্বি। রক্ত ঝরলেও সেই ম্যাচ বন্ধ হয়নি। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ২-০ এগিয়ে যাওয়া ম্যাচ ২-২ হয়ে যায় এক সময়ে। শেষ পর্যন্ত ইনজুরি টাইমে ফান পার্সির গোলে ফার্গুসনের দল ৩-২ গোলে জেতে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির বিরুদ্ধে। জয়সূচক গোলের পরেই ম্যান ইউয়ের রিও ফার্দিনান্দের দিকে ম্যান সিটির গ্যালারি থেকে পাথর উড়ে আসে। পাথরের আঘাতে তাঁর বাঁ চোখের উপরে কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। ইতিমধ্যে এক দর্শক মাঠে ঢুকে ম্যান ইউ ফুটবলারদের দিকে তেড়ে যান। তাকে আটকান সিটি গোলকিপার হার্ট। ম্যাচ অবশ্য নির্বিঘ্নেই শেষ হয়। |
যুবভারতীর ঝামেলার শুরু অবশ্য বিরতির পরের ইনজুরি টাইমে। গ্যালারি থেকে রেফারিকে লক্ষ করে দর্শকদের ইটবৃষ্টি, সেই ইট তুলে নিয়ে পুলিশের একাংশেরই পাল্টা ছুড়ে দেওয়া, গ্যালারিতে উঠে বেধড়ক লাঠিচার্জ। গ্যালারিতে দৌড়তে থাকেন আতঙ্কিত হাজার হাজার দর্শক। মুহূর্তে যুবভারতীকে গ্রাস করে ১৬ অগস্টের স্মৃতি। পায়ের চাপে আহত হন জনা পঞ্চাশ দর্শক। সারা মাঠ জুড়েই পতাকা লাগিয়েছিল ম্যাচের সংগঠক ইস্টবেঙ্গল। পুলিশের মার খাওয়া ক্ষুব্ধ মোহন-সমর্থকরা সেই পতাকা পুড়িয়ে দেন। রাস্তায় মারামারি বাধে দু’দল সমর্থকের মধ্যে। বাইপাস, কাদাপাড়া, সল্টলেকে গাড়ি ভাঙচুর হয়। গোটা ঘটনার সময় স্টেডিয়ামে উপস্থিত ক্রীড়ামন্ত্রী-সহ রাজ্যের চার মন্ত্রী।
বিরতির তিন মিনিট আগে পর্যন্তও সব মোটামুটি ঠিকঠাকই ছিল। মেহতাব হোসেনের ফ্রি-কিক থেকে দুর্দান্ত হেডে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দেন হরমনজিৎ খাবরা। তাঁর সঙ্গেই সংঘর্ষ হয় মোহনবাগানের নির্মল ছেত্রীর। গুজরাতের রেফারি বিষ্ণু চৌহান ফাউল দেন ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে। কিন্তু রহিম নবি এবং ওকোলি ওডাফা এসে রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। রেফারির দিকে তেড়েও যান ওডাফা। হাত-পা নেড়ে রেফারিকে কিছু বলতে দেখা যায় তাঁকে (রেফারির রিপোর্টে অবশ্য ওডাফা গালাগালি দিয়েছেন বলে লেখা হচ্ছে)। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে লাল কার্ড দেখান বিষ্ণু।
এর মধ্যেই দেখা যায়, লুটিয়ে পড়েছেন নবি। গ্যালারি থেকে ছোড়া ইট এসে লাগে তাঁর ডান চোখের পাশে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে বাইপাসের ধারের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। চোট গুরুতর। আজ, সোমবার তাঁর অস্ত্রোপচার।
উত্তেজনা নতুন নয় মোহন-ইস্ট ম্যাচে। প্রশ্ন, কেন এতটা আয়ত্তের বাইরে গেল গোটা পরিস্থিতি?
বিশেষজ্ঞরা দুষছেন দুই পুলিশকে। এক জন রেফারি বিষ্ণু চৌহান, যিনি গুজরাত পুলিশের অফিসার। অন্য জন, বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীবকুমার। ভেস্তে যাওয়া ম্যাচের পর দু’জনেই প্রশ্নের মুখে। দু’ভাবে। |
কেউ কেউ বলছেন, ওডাফা তাঁকে না ছোঁয়া সত্ত্বেও কেন লাল কার্ড দেখাতে গেলেন বিষ্ণু। হলুদ কার্ড দেখিয়েই তো গোলমাল এড়ানো যেত। কটূক্তি করলে লাল কার্ড বিদেশে চলে। এখানকার ফুটবলার থেকে দর্শক কেউই তার সঙ্গে অভ্যস্ত নয়। তাই বলা হচ্ছে, বিদেশি রেফারিদের অনুকরণ করতে গিয়েই ডুবিয়েছেন বিষ্ণু। মোহন-কোচ করিম এ দিন তাঁর স্ট্রাইকারকে আড়াল করেননি। বলছিলেন, “এমন শাস্তি কেন অন্য আই লিগের ম্যাচে রেফারিরা দেন না।” কিন্তু জীবনের প্রথম ডার্বি খেলানো বিষ্ণু সম্পর্কে করিম বলছেন, “ওর কাছে বিরতিতে যখন গিয়ে বললাম ফুটবল মাঠে সব কিছু কপিবুক মেনে হয় না, তখন ওর মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল খুব টেনস্ড।”
ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের প্রাধান্যই ছিল বেশি। বল পজেশনও ছিল মর্গ্যানের দলের পক্ষে ষাট শতাংশ। ফলে করিমের টিম চাপেও ছিল। এই অবস্থায় বিষ্ণুও প্রচুর ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁকে আরও ভুলের ফাঁদে ফেলেন সহকারী রেফারি দিল্লির মহম্মদ কামিল, বারবার ভুল কর্নার বা থ্রো-ইন দিয়ে। কাকতালীয় ভাবে তার প্রায় সবই যাচ্ছিল মোহনবাগানের বিপক্ষে। যে চারটি হলুদ ও লাল কার্ড সবই দেখেছেন মোহন-ফুটবলাররা। ফলে নবি-ওডাফা-নির্মলরা বারবার রেফারিকে ঘিরে ধরেছেন। যার আঁচ পড়েছে গ্যালারিতে।
আর মাঠের বাইরের পুলিশ? বরাবরের মতোই ছন্নছাড়া, পরিকল্পনাহীন। বিদেশে যে কোনও ফুটবল ম্যাচে পুলিশ সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে দর্শকদের দিকে মুখ করে। কিন্তু এখানে পুলিশও দর্শকের ভুমিকায়। ফলে গ্যালারির কোন অংশ থেকে ঝামেলা শুরু হচ্ছে তা তারা বুঝতে পারে না। হঠাৎই অফিসারদের নির্দেশে গ্যালারিতে উঠে লাঠিচার্জ শুরু করে তারা। এতে বহু নিরীহ দর্শক আহত হন। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বয়ং বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীবকুমারের গালে ইট লেগেছে।
কেন পুলিশ এ ভাবে গ্যালারিতে উঠে লাঠি চালাল, কেন গ্যালারিতে পুলিশ রাখা হয়নি, কেন পুলিশ পাল্টা ঢিল ছুড়ল, মাঠে এত ইট কোথা থেকে ঢুকল, এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি রাজীবকুমার। বললেন, “একটি নির্দিষ্ট গ্যালারি থেকে ইট ছোড়া হচ্ছিল। পুলিশ লাঠি উচিয়ে তাদের সরিয়ে দিয়েছে।”
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেল আর কত বার কলঙ্কিত হবে বাংলার ফুটবল? রবিবারের ইস্ট-মোহন ম্যাচ টিভিতে দেখিয়েছে এশিয়ার বহু দেশ। ইডেনে ক্রিকেট কভার করতে আসা ইংল্যান্ডের সাংবাদিকরাও এসেছিলেন কলকাতা ডার্বির টানে। তাঁদেরও পুলিশের তাড়া খেতে হয়েছে। ফেডারেশন প্রতিনিধির সামনে সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁরা। বিদেশি সাংবাদিকদের ক্যামেরায় বারবার ধরা পড়েছে দর্শকদের উপর পুলিশের লাঠি চালানো, তার আগে মাঠের মধ্যে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের খেলা দেখার দৃশ্য। যুবভারতীতে লক্ষাধিক দর্শক যেমন হতভম্ব হয়ে ম্যাচ ভেস্তে যাওয়া দেখেছেন, তেমনই ওঁরা আশ্চর্য হয়ে দেখে গিয়েছেন পুলিশের ব্যর্থতা। |