হলফনামায় বিচারকের সই রয়েছে। আদালতের সিলমোহরও রয়েছে। অথচ সে সব ভুয়ো! আলিপুর বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিভিন্ন বিভাগে এমন বহু সংখ্যক ভুয়ো হলফনামার হদিস পেয়ে তাজ্জব বিচারকেরাই। এমনই অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। কিন্তু, ঘটনার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও ক্ষুব্ধ আদালত।
আদালত সূত্রের খবর, বিচারকদের অগোচরে বহু বছর ধরে আলিপুরে এই কারবার চলছে। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেন্দ্রের পাসপোর্ট বিভাগে জমা পড়া হলফনামার সত্যতা যাচাই করে দেখতে সেখানকার অফিসারদের সব কাজ ফেলে প্রায়ই আদালতে আসতে হচ্ছে।
হলফনামা দু’ভাবে পাওয়া যায়। নোটারির মাধ্যমে বা বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে। জন্ম-মৃত্যু থেকে রেশন কার্ড, শিক্ষা থেকে ব্যাঙ্কের কাজ, গ্যাস সিলিন্ডারে নাম পরিবর্তন করা, পাসপোর্ট, ভোটের সচিত্র পরিচয়পত্র-সহ দৈনন্দিন প্রায় সব কাজের জন্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হলফনামা জমা পড়ে। আদালতের এক মুখপাত্র জানান, হলফনামা জমা দিতে হয় ১০ বা ২০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপারে। যার আকাল চলছে বহু দিন ধরে। ফলে, সঠিক দামের কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে হলফনামাকারীকে স্ট্যাম্প পেপার কিনতে হচ্ছে।
বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই হলফনামা করার প্রক্রিয়ায় ঝক্কি অনেক বেশি। আবেদনকারীকে অতি অবশ্যই বিচারকের সামনে সশরীর হাজির হয়ে জবাবদিহি করতে হয়, কেন তিনি হলফনামা জমা দিয়েছেন। এই পদ্ধতি এড়াতে বেশি অর্থ খরচ করে, দালালের মাধ্যমে হলফনামা জোগাড় করেন মানুষ।
আর এই ঘুর পথকে কেন্দ্র করেই ভূয়ো হলফনামার রমরমা চলছে আলিপুরে। বিষয়টি আলিপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের নজরে আসে। সংগঠনের সহকারী সম্পাদক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “চলতি বছরে অন্তত ১২ হাজার জাল হলফনামা বেরিয়েছে।” গত ১৭ অক্টোবর শশীকান্ত শ্যামল নামে এক টাইপিস্ট ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আলিপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন পার্থবাবু। আদালতের সিলমোহর ও ম্যাজিস্ট্রেটের সই জাল করার অভিযোগ আনেন তিনি। গত ১৬ নভেম্বর জেলা ও দায়রা বিচারকের আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পান ওই ব্যক্তি। তবে এই কেলেঙ্কারির অভিযোগে আর কেউ ধরা পড়েননি।
হলফনামা কেলেঙ্কারির তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত আলিপুর থানার অফিসার পি কে মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকায় আদালত সন্তুষ্ট নয়। ওই অফিসার বাজেয়াপ্ত জাল হলফনামাগুলি কেস-ডায়েরিতে না-রেখে থানার মালখানায় রাখার আর্জি জানিয়েছেন। তাতে ওই নথিপত্র নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পি কে মুখোপাধ্যায়ের এই আচরণে বিস্মিত আদালত। তাই পরে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশকে। তাতেও অবশ্য স্বস্তি নেই। তদন্তের স্বার্থে আদালতের সিলমোহর ও ম্যাজিস্ট্রেটের সইয়ের নমুনা সংগ্রহ করার অনুমতি পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু, তদন্তকারী অফিসার এ কে বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও পর্যন্ত ওই কাজ করে উঠতে পারেননি। উল্টে তিনি ওই নমুনা সংগ্রহের আদেশটি পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছেন। অফিসারের এই ভূমিকায় আদালত রীতিমতো ক্ষুব্ধ। অভিযুক্ত শশীকান্ত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন বলে কথা দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু, তাঁকে এখনও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা হয়নি। |