ব্যাঙ্ককে বাঙালি
ব্যাঙ্ককে ঋতুপর্ণা। নিউ ক্যাসলে প্রসেনজিৎ। লন্ডন ঘুরে এলেন দেব।
বাংলা সিনেমার এখন পায়ের তলায় সরষে। ব্যাঙ্কক থেকে লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যখন প্রথম ব্যাঙ্ককে শ্যুটিং করতে গেলেন, তাঁর হেয়ার ড্রেসার শ্যুটিংয়ের মাঝেই গাছে চড়েছিলেন। এর আগে এমন রসালো ফল কখনও তিনি দেখেননি। তাই ওটা তাঁর চাই। সে ছিল এক দশক আগের কথা। শ্যুটিং হচ্ছিল ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম প্রযোজনায় ‘রাঙা বউ’ ছবির।
কাট টু। ফিরে আসি বর্তমানে। ব্যাঙ্কক আর পাটায়া তো এখন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের দ্বিতীয় বাড়ি। আজকে আর তাঁর হেয়ার ড্রেসার গাছে চড়েন না ফল যতই লোভনীয় হোক না কেন। পাটায়ার মতো জায়গায় অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মিসেস সেন’ ছবির সারাদিনের ব্যস্ত শ্যুটিংয়ের পর সেই হেয়ার ড্রেসার এখন বরং ফুট ম্যাসাজ নেন। মাছেরা তাঁর পায়ে এসে আরামের কামড় দেয়। বিদেশে বাংলা ছবির শ্যুটিং এখন রোজকার ঘটনা। শহরের মোড়ে মোড়ে ছড়িয়ে থাকা ম্যাসাজ পার্লারের কোনটাকে বেছে নেওয়া যায় সে সব তিনি ভালই জেনে গিয়েছেন।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর ক্ষেত্রে এই শহরটা আজ অনেক বেশি চেনা। এই নিয়ে ছ’বার শ্যুটিং করলেন ব্যাঙ্ককে। কোরাল আইল্যান্ডে কিংবা রোদ্রস্নাত সমুদ্র সৈকতে সারাদিনের শ্যুটিং, আর তার পর তাই ফুট ম্যাসাজ এ সবই ঋতুপর্ণার হালের তাইল্যান্ড ডায়েরির অংশ। অনেক বদলের মধ্যে একটা ব্যাপার যা বদলায়নি তা হল এয়ারপোর্টে অতিরিক্ত মালপত্রের জন্য বাড়তি টাকা দেওয়া। কারণ ব্যাঙ্ককে শ্যুটিং মানেই একগাদা শপিং। এমনকী তাঁর মা-ও মানিয়ে নিয়েছেন শ্যুটিংয়ের ফাঁকে তাঁর স্কুইড খাওয়ার সঙ্গে। প্রথম দিকে তো তিনি ওই সব বাচ্চা অক্টোপাস খাওয়া সহ্যই করতে পারতেন না। “এখন মাকেও শিখিয়ে দিয়েছি স্কুইড খেতে। শুধু পোকা ভাজাটা খেতে শিখিনি এখনও,” ঋতুপর্ণা হেসে জানালেন।
পাটায়ায় যে বাড়িতে ছবির শ্যুটিং হচ্ছিল তা এক কথায় রুদ্ধশ্বাস সুন্দর। ভারতে এমন লোকেশন পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাড়ি। বাড়ির বাঁ দিকে উঠে গেছে পাহাড়। সমুদ্রে লক্ষ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট ডিঙি। তীরে এসে আছড়ে পড়ছে অলস ঢেউ। ডিসেম্বরের উষ্ণতার ওম নিতে সেখানে জড়ো হয়েছে বিদেশিরা। তাঁদের কেউ কেউ আবার ঢেউয়ের মাথায় চড়ে সার্ফিংয়ে মগ্ন। |
এক্সক্লুসিভ ছবি
পাটায়াতে ‘মিসেস সেন’ ছবিতে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত |
এখন শুধু পাটায়া আর ব্যাঙ্ককেই আটকে নেই বাংলা ছবির শ্যুটিং। তার পরিধি এখন অনেক বড়। বাংলা ছবির গানের সুন্দর থেকে সুন্দরতর লোকেশন বাছা এখন নিত্যকারের ব্যাপার।
‘অনুরণন’এর লন্ডনে শ্যুটিং করার পর থেকেই বাংলা ছবির বিদেশে শ্যুটিং করার প্রবণতা বেড়ে যায়। পরিচালক অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীকে অনেকেই তাই বিদেশে শ্যুটিংয়ের ‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস’ বলেন। ‘অনুরণন’এর পর তিনি ‘অপরাজিতা তুমি’র পুরো শিডিউল সানফ্রান্সিসকো-তে শ্যুটিং করেন। কিন্তু ‘কলম্বাস’ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিদেশে শ্যুটিং করার মডেলটা সেই অর্থে কাজ করেনি।
“হ্যাঁ, বিদেশে শ্যুটিংয়ের হিড়িক পড়ে যায় ‘অনুরণন’ লন্ডনে শ্যুটিং হওয়ার পর থেকে। কিন্তু কমার্শিয়াল ছবি ছাড়া বাংলা ছবির বিদেশে শ্যুটিং করা ইকোনমিকালি ভায়াবেল নয়। তার কারণ আমরা যেরকম ছবি করি তা শুধু ২৫-৩০টা হলে মুক্তি পায়। যদি আমাদের ছবিও ১৫০রও বেশি হলে মুক্তি পায় তা হলে মডেলটা প্রফিটেবল হবেই। কারণ লোকে নতুন লোকেশন দেখতে সব সময়ই উদগ্রীব,” জানাচ্ছেন অনিরুদ্ধ।
মিউজিক চ্যানেলগুলোতে রোজ যে সব গানের দৃশ্য দেখানো হয় তা তো সব বিদেশেই শ্যুট করা। যেমন লন্ডনে দেব আর কোয়েলের নাচের দৃশ্য অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার মরুভূমিতে জিৎ-নুসরতের রোমান্স, শ্রীলঙ্কায় দেব আর পায়েলের গানের দৃশ্য। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তো শ্যুটিং লোকেশনের চেনা ছক ভেঙে পৌঁছে গেছেন আইসল্যান্ডের মতো দুর্গম অঞ্চলে। ‘হনুমান ডট কম’এর শ্যুটিংয়ের জন্য। এমনকী জর্ডনেও পা পড়েছে বাংলা সিনেমার। এ বার অপেক্ষা বাংলা ছবির পর্দায় মিশরের মমির জীবন্ত হয়ে ওঠা।
প্রথম বিদেশের মাটিতে শ্যুট করার রোমাঞ্চটা এখন আর না থাকলেও প্রযোজকরা কিন্তু মনে করছেন এখনও বিদেশি লোকেশন বক্স অফিসে ভালই কাটছে। অন্য দিকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মনে করছেন চিত্রনাট্যে বিদেশি লোকেশন থাকলে শ্যুট করার কারণটা আরও জোরদার হয়।
আভিজাত্যে মোড়া তসরের শাড়ি আর ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুরের টিপে পুরোপুরি মিসেস সেন হয়ে উঠেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। একটা কাঠের সেতুর ওপর তিনি দাঁড়িয়ে। সেই সেতু এতটাই সরু আর পলকা যে দশজনের বেশি ওজন বইতে পারবে না। ধীরে ধীরে তিনি হেঁটে গেলেন কাঁঠালিচাঁপা গাছের দিকে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রথম বার ব্যাঙ্ককে শ্যুটিং করতে এসে আমার হেয়ার ড্রেসার যখন অচেনা লোকের বাড়ির আমগাছে চড়েছিল, আমি বলেছিলাম ওকে আমি চিনিই না। এতটাই অস্বস্তিতে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু আজ ব্যাপারটা পুরো আলাদা।” |
কে কোথায় কতবার |
|
প্রসেনজিৎ |
|
|
জিৎ |
|
অভিনয় জীবনের
প্রথম ২৫ বছর: রায়চক,
ফলতা,
পুরী, দীঘা
প্রথম সুপারহিট ছবির
আউটডোর: দার্জিলিং
অমর প্রেম: শিলং
জুহি চাওলার সাথে ছবি: উটি
তারপর
সানফ্রান্সিসকোতে
অপরাজিত তুমি।
জর্ডন: ১ বার
আইসল্যান্ড: ১ বার।
বাংলা সিনেমার শ্যুটিং এর
ক্ষেত্রে বলা যায় দুর্গম এবং সুন্দর জায়গা।
পরের ছবির শ্যুটিং করে সবে
ফিরেছেন ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসল থেকে।
পরের বছরের শুরুতে মিশর
যাচ্ছেন কাকাবাবুর শ্যুটিং করতে। |
সিঙ্গাপুর: ৪ বার
তাইল্যান্ড: ৩ বার
মালয়েশিয়া: ২ বার
তুরস্ক: ১ বার
ইতালি: ১ বার
মাসকট যাচ্ছেন পরের ছবির শ্যুটিং করতে
|
দেব |
সুইৎজারল্যান্ড: ৬ বার
দক্ষিণ আফ্রিকা: ১ বার
ইতালি: ৩ বার
ইউ কে: ১ বার
দুবাই: ৩ বার
সিঙ্গাপুর: ৩ বার
মালয়েশিয়া: ৩ বার
শ্রীলঙ্কা: ১ বার |
|
এই প্রথম তাইল্যান্ডে কাঁঠালিচাঁপা গাছ খুঁজে পেলেন ঋতুপর্ণা। ছবির শিশুশিল্পী ঋষি এক গোছা ফুল নিয়ে তাঁর হাতে দিল। লোকেশনে আসার পথে মাঠের মধ্যে হঠাৎ ঋতুপর্ণার নজরে পড়ল কাশফুল।
যেন হঠাৎ খুঁজে পাওয়া এক টুকরো নিশ্চিন্দিপুর। সিনেমা তো ভূগোলের ক্লাস নয় যে সব কিছু ভৌগোলিক নিয়মমাফিক হবে।
চিত্রনাট্যের সঙ্গে যদি লোকেশনকে মিশিয়ে ফেলা যায় তবেই পর্দায় সেই রসায়নটা কাজ করবে। দর্শকরা মোটেই আর যশ চোপড়ার যুগে পড়ে নেই। যেখানে সুইৎজারল্যান্ড সম্পর্কে তাঁদের ধারণা তৈরি হবে সিনেমার গান থেকে। বরফে ঢাকা পাহাড়ের সামনে শিফন শাড়ি পরে গানের সুরে ঠোঁট নাড়াচ্ছেন নায়িকারা। বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে শুধু মাত্র দুটো গান বিদেশে শ্যুট হয়েছে এমন ছবি দেখতে দর্শকরা আর যেতে চান না। “যদি গল্পের সঙ্গে লোকেশনের সম্পর্ক না থাকে তবে দর্শকও সে ছবি দেখবেন না। আমার ‘অনুরণন’ লন্ডনে শ্যুট হওয়া প্রথম বাংলা ছবি। গল্পটাও ওখানকার। তাই বিদেশে শ্যুট করার একটা মানে ছিল। আর সেই কারণে দর্শকদেরও ভাল লেগেছিল ছবিটা। আমরা ‘পিয়ালীর পাসওয়ার্ড’এর শ্যুটিং করি সানফ্রান্সিসকোয়। কারণ গল্পটা ওখানকার পটভূমিতে। তবে কিছু বাংলা ছবিতে জোর করে বিদেশি লোকেশন ঢোকানো হয়।” বললেন ঋতুপর্ণা।
‘মিসেস সেন’ ছবির গল্পের সঙ্গে ব্যাঙ্ককের সম্পর্ক নিবিড়। “এটা এক জন মানুষের দুটো জীবন কাটানোর গল্প। একটা জীবন কলকাতায়। অন্যটা তাইল্যান্ডে। সেই মানুষের দুই বউয়ের দেখা হয়ে যায় যখন, তখনই গল্প নাটকের তুঙ্গ মুহূর্তে পৌঁছোয়।
প্রাথমিক ভুল বোঝাবুঝির অবসানের পর দুই নারীর মানসিক বোঝাপড়া তৈরি হয়। ছবিটা থাইল্যান্ডে শ্যুট করতেই হত। স্টোরি লাইনটা তো তাইল্যান্ডের। ঋষিতা ভট্ট চরিত্রটি তাইল্যান্ডে থাকে।” বললেন পরিচালক অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়।
|
ইতালিতে দেব |
সুইৎজারল্যান্ডে জিৎ |
|
প্রযোজকরাও স্বাভাবিক ভাবে বিদেশে শ্যুটিং করার ব্যাপারে তৈরি। বিদেশে শ্যুটিং করা ঠিক হবে না ভুল, তা নিয়ে কেউই এখন মাথা ঘামাচ্ছেন না। ‘মিসেস সেন’য়ের প্রযোজক পঙ্কজ আগরওয়াল যেমন মনে করেন, তাইল্যান্ডে শ্যুটিং করা এখন হায়দরাবাদে শ্যুটিং করার থেকে সস্তা। “দেশের মধ্যের বিমান ভাড়া এখন খুব বেড়ে গেছে। কলকাতা ব্যাঙ্ককের রিটার্ন টিকিট আমি বারো হাজার টাকায় পেতে পারি। কিন্তু ওই টাকায় হয়তো হায়দরাবাদের টিকিটই হবে না। তাছাড়া বিদেশে শ্যুটিং মানেই অল্প ক্রু। সেটাও বেশ খানিকটা বাজেট কমিয়ে দেয়। বিদেশে কাজও অনেক তাড়াতাড়ি হয়। ভারতে যেখানে শিল্পীদের অন্য কাজ থাকে, বিদেশে সেখানে তাঁরা শুধু শ্যুটিংয়ের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। কলকাতায় যেটা বেলা ২টোয় শুরু করতে হত, সেটাই বিদেশে ১১টার মধ্যে শুরু করে দেওয়া যায়,” পঙ্কজ জানান।
প্রযোজক রানা সরকারও পরের বছর পর্তুগালে শ্যুটিং করবেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘জাতিস্মর’। “ছবিটার পটভূমি পর্তুগালে। তাই অন্য কোনও বিকল্প জায়গা ভাবার কথা সম্ভবই না। জিৎ বা দেবও বাণিজ্যিক ছবিতে এই ধরনের সুন্দর জায়গায় শ্যুটিং করলে, ছবির খরচ উঠে আসে। তা ছাড়া ছবির মাঝখানে যদি কোনও চমক আনতে হয়, বিদেশে শ্যুট করলে ভাল খোলে। তবে এরকমটা না হলে বড় তারকা ছাড়া বিদেশে যাওয়ার কোনও মানেই নেই। তবে মাঝারি বাজেটের বাংলা ছবির শ্যুটিং ব্যাঙ্কক বা সিঙ্গাপুরে খুব অল্প খরচেই হয়ে যায়,” বললেন রানা।
ব্যাঙ্ককে যাতে সস্তায় বাংলা ছবির শ্যুটিং করা যায় তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করছেন ঋতুপর্ণাও।
‘মিসেস সেন’এর শ্যুটিং করতে এসে ভাবছেন তাইল্যান্ডের যে বাড়িটায় শ্যুটিং হচ্ছে সেটা কিনবেন।
স্পার্টার নকশায় তৈরি বাড়িখানা। মেঝে কাঠের। বাড়ির সামনে একটা ছোট সুইমিং পুল। যার জল মাটির সমান সমান ভাবে বইছে। কোনও পাড় নেই। যাকে এক কথায় বলে ইনফিনিটি সুইমিং পুল। শ্যুটিংয়ের ইউনিটের কেউ কেউ ঋতুপর্ণাকে এই বাড়িটা কেনার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ বাড়িটা বিক্রি হবে বলে শোনা যাচ্ছে।
সুইমিং পুলের পাশে দাঁড়িয়ে ঋতুপর্ণা মনে মনে দেখতে পাচ্ছেন সেই বাড়িটা কেনা হয়ে গেছে। আরও মনের মতো করে সাজিয়েছেন বাড়ির চারিধার। কাঁঠালিচাঁপা গাছটা ফুলে ফুলে ভরাট। কলকাতা থেকে শ্যুটিং-এর দল এসেছে।
শিল্পী কলাকুশলীরা চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর নতুন কেনা লোকেশনে। শ্যুটিং হচ্ছে আগামী দিনের কোনও বাংলা ছবির। পরিচালক যেন বলে উঠলেন লাইট... সাউন্ড....ক্যামেরা.. অ্যাকশন... |
|