আমরি অগ্নিকাণ্ডের এক বছর: দমকলে দায় ঠেলছে স্বাস্থ্য দফতর
আমরির শিক্ষা শিকেয়,
নজরদারিতে জলাঞ্জলি
য়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরে বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই স্বাস্থ্য দফতরে ফিকে হয়ে গিয়েছে আমরি-স্মৃতি। এতটাই ফিকে যে, সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালেই নজরদারি বন্ধ। কোন বেসরকারি হাসপাতাল আগুন নিয়ন্ত্রণে কী কী ব্যবস্থা চালু করেছে, তা খতিয়ে দেখা তো দূরের কথা, পৃথক কমিটি গড়া ছাড়া সরকারি ক্ষেত্রে এখনও তেমন কোনও পদক্ষেপও করা হয়নি।
এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে এত হেলাফেলা কেন? রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা সাফ জানাচ্ছেন, তাঁদের লোকবল নেই। তাই পরিকল্পনায় লাভ নেই।
তা হলে ঘটনার পরে পরেই ঢাকঢোল পিটিয়ে এমন নজরদার কমিটি গড়ারই বা কী দরকার ছিল?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন’ রাখতে নজরদার কমিটি গড়া হয়েছিল। কম লোকবল নিয়েই মাস তিনেক বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে পরিদর্শনও হয়েছে। কিন্তু তার পরে আর সেই অভিযান চালিয়ে যেতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর। ওই দফতরের এক প্রাক্তন কর্তা বলেন, “আসলে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে চাপ কমে গিয়েছিল। আর স্বাস্থ্য দফতরে এক জন প্রতিমন্ত্রী আসার পরে আমাদের উপর থেকে চাপটা পুরোপুরিই চলে গিয়েছে।”
সেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী বলছেন? স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের মতে, অগ্নি নির্বাপণ পরিকাঠামো ঠিক রয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব দমকলের। স্বাস্থ্য দফতরের কিছু করার নেই। তিনি বলেন, “লাইসেন্স নবীকরণের জন্য যেটুকু দেখা দরকার, তা আগেও দেখা হত, এখনও হয়। বিশেষ পরিদর্শনের প্রশ্ন তখনই ওঠে, যখন কোনও ক্ষতি হয়। বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে নিয়ন্ত্রণের এক্তিয়ার নেই সরকারের।”
আইন তো প্রশাসনের হাতিয়ার। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না কি?
ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইন সংশোধনের সময়ে আমরি-কাণ্ডের ‘শিক্ষা’ গুরুত্ব পাবে বলেও তখন জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। আমরিকে দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হবে বলেও জানিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু কাটছাঁট করতে করতে খসড়া আইনটি এখন যা দাঁড়িয়েছে, তাতে নজরদারির বিষয়টিকে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। খসড়ায় কাটছাঁট করতে করতে সেটাও এখন কমজোরি। ফলে আইন হলেও তাতে যে পরিস্থিতি পাল্টাবে, আশা করছেন না কেউই। নড়বড়ে আইন, প্রশাসনের উদাসীনতার ফাঁকে অনিয়মটাই এখন বহু হাসপাতালের ‘নিয়ম’। যেমন মুকুন্দপুরে মহিলা ও শিশুদের জন্য আমরির যে-হাসপাতাল ছিল, সেটি গড়ে উঠেছিল ‘ভিশন কেয়ার’ নামে একটি সংস্থার তরফে চোখের হাসপাতালের জন্য নেওয়া একটি জমিতে। দিনের পর দিন এই অনিয়ম চলেছে। কিন্তু ২০১১-এর ৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকুরিয়ার আমরিতে অগ্নিকাণ্ডের পরে মুকুন্দপুরে আমরি হাসপাতালের নাম বদলে হয়ে যায় ‘ভিশন কেয়ার’। নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এ ভাবেই পরিকাঠামো বাড়িয়েছিল শহরের কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। কিন্তু তা দেখার কেউ নেই।
স্বাস্থ্য প্রশাসন যে কিছুই দেখছে না, অনেক হাসপাতালের প্রতিনিধিদের বক্তব্যেও তার প্রমাণ মিলছে। বাইপাস সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিফ ম্যানেজার তাপস ঘোষ বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানের বেসমেন্টে লন্ড্রি ছিল। সরিয়ে দিয়েছি। স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে ‘ড্রিল’-এরও ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের কেউ খবরই করে না।” অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার সিঞ্চন ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা নিয়ম মানছি। ফায়ার অ্যালার্ম বসানো হয়েছে। হিটারের বদলে ইন্ডাকশন কুকার। বেসমেন্টে শুধু গাড়ি থাকে।” সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বলেন, “বেসমেন্ট খালি। দমকল তবু খোঁজ নেয়। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের দেখা নেই।”
ঢাকুরিয়ায় আমরি-তে বেসমেন্টের দাহ্য পদার্থ থেকেই ছড়িয়েছিল আগুন। বহু হাসপাতালেই বেসমেন্টই সম্ভাব্য বিপদের আঁতুড়ঘর। সল্টলেক, বাইপাস, আলিপুরের বহু হাসপাতালের বেসমেন্ট দাহ্য পদার্থের স্তূপ। বহু হাসপাতালেই ছাদ থেকে জল ছিটানোর ‘স্প্রিঙ্কলার’, পর্যাপ্ত ‘ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার’-ও নেই। সরকারি হাসপাতার্লে বিদ্যুতের তার বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। হাসপাতাল-চত্বরে উনুন জ্বেলে চলছে ক্যান্টিন। দরপত্র-প্রক্রিয়ার গেরোয় বহু জায়গায় আসেনি ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার।
বেসমেন্টে কাজ চলছে এসএসকেএমে। বাঘা যতীন হাসপাতালের বেসমেন্টের লন্ড্রি কিছু দিন বন্ধের পর ফের চলছে। মেডিক্যালের গ্রিন বিল্ডিংয়ের বেসমেন্টে আসবাব ঝালাই হয় আগুন জ্বেলেই। আরজিকরে বেসমেন্টে ওষুধের গুদাম।
আমরি-কাণ্ডের পরে অগ্নি-সুরক্ষায় কিছু নিয়মের কথা বারবার বলা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাস্টি বোর্ড পরিচালিত, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি হাসপাতাল জানিয়ে দেয়, তারা এত নিয়ম মানতে পারবে না। তাই হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। স্বাস্থ্য দফতর পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে পাল্টা কোনও পদক্ষেপ করেনি। তবে প্রবল চাপের মুখে পড়ে তারা বিশেষত জেলায় গজিয়ে ওঠা পরিকাঠামোহীন নার্সিংহোম- ক্লিনিকের লাইসেন্স আটকাতে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী আবেদনের তিন মাসের মধ্যে সরকার কিছু না-জানালে ধরে নেওয়া হয়, নবীকরণ হয়ে গিয়েছে। আইনের ফাঁক গলে তাই নার্সিংহোমগুলি অসম্পূর্ণ পরিকাঠামো নিয়ে ব্যবসা চালাতে থাকে। কিন্তু এ ভাবে যে বেশি দিন চলবে না, তা বুঝে নতুন নিয়ম করে স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “দমকলের ছাড়পত্র না-দিলেও চলবে। যদি প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হলফনামা দিয়ে কোনও হাসপাতাল জানায়, পরিকাঠামো আছে বা যা যা নেই, দ্রুত করা হবে ও সেই মর্মে সার্টিফিকেটও পায়, তবে তাদের লাইসেন্স নবীকরণ হয়ে যাবে।” কিন্তু হাসপাতালগুলি প্রতিশ্রুতি মানছে কি না, সেটা দেখবে কে? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলে দিচ্ছেন, “এটা দেখা স্বাস্থ্যকর্তাদের কাজ নয়। পরিকাঠামোও নেই আমাদের। এটা দমকল দেখবে।” কিন্তু দমকল সেটা দেখল কি না, তা দেখার দায়িত্ব কার?
জবাব নেই কারও কাছেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.