ঠেলেঠুলে কোন অতীতকে আগে আনব বুঝে উঠতে পারছি না! ছত্রিশ বছর আগের লজ্জার সকাল? নাকি এগারো বছর আগের মাণিক্যখচিত শেষ বিকেল?
প্রথমে লজ্জার সকালে আসি। তৃণমূল তো নয়ই। এমনকী সিপিএম-ও নয়। রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের লজ্জার ক্রিকেট-সকাল। রবিবাসরীয় ইডেনে যা অবধারিত প্রত্যাবর্তন ঘটাবে।
আপার টিয়ারে গোটা দুপুর এ দিন জনতার মধ্যে বসে যিনি খেলা দেখছিলেন, ছত্রিশ বছর আগে ছিলেন তিনি ইডেনের শেষ দিনের ‘অশ্বিন’। তিনি ব্রিজেশ পটেল। স্ট্রোকখচিত ৫৬ রানের ইনিংসে টনি গ্রেগের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইনিংসে হার বাঁচিয়েছিলেন। এখানে ভারত এগিয়ে আছে ৩২ রানে। সিদ্ধার্থ রায়ের সেই আমলে ইংল্যান্ডকে জেতার জন্য করতে হয়েছিল তার অর্ধেক রান ১৬। কলকাতা দুদ্দাড়ে ভুলে যেতে চাইলেও গোটা ক্রিকেট বিশ্ব সেই ম্যাচ নিয়ে আলোচনা আজও জীবন্ত রেখে দিয়েছে। ব্রিজেশের জন্য অবশ্যই নয়। ওইটুকু সময় খেলা এবং ভারতের হার দেখতে যে ব্যাকুল আশি হাজার লোক পঞ্চম দিন এসেছিল, তার কথা বিস্মিত ভাবে স্মরণ করে।
ইডেনে এ বারের টেস্টও দশ উইকেটে হেরে ভারতের সিরিজে ১-২ পিছিয়ে যাওয়া উচিত। শুক্ল পরিবারের ইংরেজ ক্রিকেট টিমের ব্যান্ড বাজিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপনী স্বপ্ন আগামী কাল চূড়ান্ত ভাবে ধোনিরা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন। টনি গ্রেগ আর অ্যালিস্টার কুক জয়ী দুই সেনাপতির সময়কাল এত আলাদা! ইডেন অবিকল পরিস্থিতিতে ছুটির দিনে এক হাজার লোকও আনতে পারলে হয়। কিন্তু অবিকল পরিস্থিতি বলে ম্যাচ রিপোর্টে সেই দিনটাই কি প্রথম আসা উচিত? নাকি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, এগারো বছর আগের বৃত্তের সমাপ্তি। বৃত্তচাপটা পুরো জুড়ে যাওয়া! |
চলতি শতাব্দীর প্রথম বছরে প্যাগোডা সমন্বিত উদ্যানেই টিম ইন্ডিয়া কনসেপ্টের সূচনা। অত্যাশ্চর্য ভাবে স্টিভ ওয়-দের গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সৌরভের ভারতকে ঘিরে একটা প্রবাদ তৈরি হয়ে যায়। যে এরা ক্রিকেট মাঠে সবচেয়ে জঙ্গি আউটফিট। হারের মুখে দাঁড়িয়েও হারতে শেখে না। পতনের কিনার থেকে বারবার জয় ছিনিয়ে নেয়। ওয়াসিম আক্রম এই সময় পাকিস্তান টিমে থেকেও বলতে থাকেন, “এদের দেখে আমার ইমরানের পাকিস্তানকে মনে পড়ে যায়। একই রকম মারকাটারি।” প্রবাদের আগুনে আর একপ্রস্ত সলতে যেন জ্বালা হয়ে যায়। ক্রিকেট অদৃষ্টের এমনই পরিহাস, যে মাঠ সেই কোহিনুর পরিয়েছিল, সেই মাঠই কি না কোহিনুর কেড়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে দিচ্ছে।
ধোনির যে টিম ইন্ডিয়া-র সাক্ষাত ইডেনবাসী পেলেন, তারা এক মৃতপ্রায় সভ্যতা। পোড়ো এক বহুতল বাড়ি। সহজ উইকেটে ৭০ মিনিটের মধ্যে যাদের ছ’জন সেরা ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যেতে পারে। জীর্ণ সেই বহুতলকে জীবনমুখী করার জন্য অবশ্যই প্রোমোটারের হাতে তুলে দেওয়ার সময় হয়েছে। শ্রীনি-ধোনি কম্বিনেশনেও আর কেলেঙ্কারি ঢেকে রাখার উপায় নেই। গতকাল ইডেনে ম্যাচ দেখতে এসে শ্রীনিবাসন একহাত নিয়েছিলেন মুখুজ্যেবাবুকে। এ দিন তাঁরই পেটোয়া লোক প্রাক্তন নির্বাচকপ্রধান কৃষ্ণামাচারি শ্রীকান্ত টেলিভিশনে বলে দিলেন, “পিচের জন্য ভারত ম্যাচ হারেনি।” আর বললেন, “ভারতীয় দলে বড় রকমের গড়বড় চলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।” লাইভ টিভি সাক্ষাৎকারবলার উপায়ও নেই, বলিনি। কেমন দাঁড়াতে পারে নতুন প্রোমোটার যদি নতুন টিম ইন্ডিয়া তৈরি করতে চান। ভারতীয় ক্রিকেটমহলের সেন্টিমেন্ট হল, শীর্ষে বড় রকমের রদবদল দরকার। কোচ ফ্লেচারকে পুরো মরসুমের চুক্তি থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার আগেই সরাতে হবে। আর দ্রুত টেস্টে বদলাতে হবে অধিনায়ক ধোনিকে। সমস্যা হল, শ্রীনিবাসন চটে যেতে পারেন, ভয়ে এক ওই দুঃসাহসী বেদী ছাড়া আর কেউ কথাটা সরাসরি বলে উঠতে পারছেন না। নির্বাচক কমিটিরও রবিবার কলকাতার বৈঠকে বসে জবাবদিহি করার মতো সাহস নেই। ওটা করতে পারতেন এক মোহিন্দর অমরনাথ। তাঁকে তো ছেঁটে ফেলা হয়েছে। সুতরাং, ইংল্যান্ড সিরিজের পর ধোনি নিজেই যদি টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়ে না দেন, তাঁর শিকড় ধরে টান মারার সাহস নির্বাচকদের নেই। চাইলে টিম ইন্ডিয়া-র অরিজিনাল স্রষ্টা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে উপদেষ্টা হিসেবে আনতেই পারে বোর্ড। এ বার আইপিএলে না থাকা সৌরভ সময়ও পেতেন নতুন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে জেনারেশন ওয়াই-এর নতুন টিম ইন্ডিয়া তৈরির। কিন্তু সচিনের ফুটওয়ার্ক যতটা অবিশ্বাসযোগ্য হয়ে পড়ছে, ততটাই অবিশ্বাসী শ্রীনিবাসনসৌরভকে সামলানো নিয়ে। কী গ্যারান্টি আছে যে, কোচ হয়ে কথা শুনবে! তখন কন্ট্রোলফ্রিক শ্রীনিবাসন তো সমস্যায় পড়ে যাবেন। এমনিতে সৌরভ চ্যালেঞ্জ নিতে যথেষ্ট ইচ্ছুক। |
কিন্তু তিনি নিজেও জানেন, বোর্ডের ইয়েসম্যান তাঁর দ্বারা হওয়া হবে না। তাই শনিবার রাতে খোলাখুলি বললেন, “আমি কোচ হতে চাই কি না, তা দিয়ে কী হবে? বোর্ড কাকে করতে চায় সেটা সবচেয়ে জরুরি।” আর বললেন, ইডেনে টিম ইন্ডিয়া-র ভেঙে পড়াটা তাঁর কাছে মর্মান্তিক নয়। মনে হল সেই দলে তিনি পড়ছেন, যাঁরা মনে করেন, বিপর্যয়টা খুব স্বাভাবিক পরিণতি ছিল। কেবল অদৃষ্টের পরিহাসে যেখানে দৌড়টা শুরু হয়েছিল, সেখানেই সমাপ্ত হল!
শ্রীনিবাসন গতকাল হাঁড়িকাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুঁজে পেয়েছিলেন মুখুজ্যেবাবুকে। আজ এক জন ক্যান্ডিডেট বাড়ল। যুবরাজ সিংহ। সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন যুবরাজ। জানতেন তিনিই টিমের অলিখিত তৃতীয় স্পিনার। তা গোটা সিরিজে বল পেয়েছেন মাত্র ১৩ ওভার। বলের সাফল্যে ব্যাটিং ভীতি থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে, এমন কোনও সুযোগই অধিনায়ক তাঁকে দেননি।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন এ দিনের অপরাজিত ৮৩-তে যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, সেটা এই তথ্য নয় যে, তিনি দারুণ বোলার এবং পরের টেস্টে তাঁকে রাখা উচিত। অশ্বিনের তিন ঘণ্টা ক্রিজে থাকা বুঝিয়েছে, উইকেটে মন্বন্তরের কোনও গল্প ছিল না। বুঝিয়েছে এই যে, সবাই মিছিল করে ফেরত এল, তার অর্থ স্কিলের অভাব, মানসিকতার অভাব। নইলে প্রজ্ঞান ওঝা আর অশ্বিনের এতক্ষণ উইকেটে টিকে থাকার কথা নয়। টেলএন্ডাররা যত ইনিংস পরাজয় বাঁচিয়েছেন, ততই আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদেরই ব্যাটসম্যানরা। ইডেন উইকেট থেকে শবযাত্রা শুরু হল বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে। লাঞ্চের পর প্রথম বলেই সহবাগ। মিছিল প্রাথমিক ভাবে শেষ হল একটার সময়, ধোনির তৃতীয় বলে অফ স্টাম্পের বাইরে খোঁচা দিয়ে। ইংল্যান্ড এর মধ্যেই অবশ্য দেখিয়ে দিয়েছে, কেন তারা বিশ্বের এক নম্বর দল নয়! কেন তারা হাসিম আমলাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। সহবাগকে ১৭ রানে ছেড়েছে স্লিপে। অশ্বিনের স্টাম্পিং মিস করেছে শুরুর দিকে। ইশান্তের ক্যাচ ফেলেছে। তিনটে সুযোগই এমন যে, নষ্ট করা ফিল্ডার সিএবি দ্বিতীয় ডিভিসনেও পরের ম্যাচে বাদ পড়তে পারে।
প্রেসবক্সে ওই সময় সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জিওফ্রে বয়কট। বয়কটের মা ক্রিকেটে একটা প্রতীকী চরিত্র। যাঁর ব্যাটিং ক্ষমতা নিয়ে কখনও কাব্য লেখা হবে না। তা বয়কট হাসতে হাসতে বললেন, “এই যা বোলিং, আমার মা-ও খেলে দিত।” বয়কটের বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে যে সব ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা, তার অন্যতম অবশ্যই সচিন তেন্ডুলকর। এবং খুব ন্যায্য কারণে। সিরিজের শেষ টেস্ট নাগপুরে, যেখানে ভারতের আর বদলা নেওয়ার সুযোগ নেই। সচিনের ব্যক্তিগত ইমেজ রক্ষার সুযোগ আছে। নাগপুরের গণেশ দেবতা নাকি ক্রিকেট মাঠে সচিনকে কখনও খালি হাতে ফেরাননি। ইডেনে শেষ টেস্ট ইনিংসের চরম ব্যর্থতা কিন্তু ইতিহাসে থেকেই গেল। ওটা সিদ্ধিদাতারও সীমানার বাইরেপরপারে। এ দিন ঠিক দুপুর ১২টা ১২-য় পূজারা রান আউট হতে তুমুল হর্ষধ্বনি উঠল। যেন এখনই আসছেন বিপত্তারণ। বিদায়ী সংবর্ধনায় উঠে পড়ল গোটা গ্যালারি। ঠিক তখনই ছুটতে ছুটতে প্রেসবক্সের পাশে বিবিসি স্টুডিওয় ঢুকে পড়লেন রাহুল দ্রাবিড়। ওই দৌড়টা পূজারাকে ধার দিলে রান আউটটা ঘটত না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা রাহুলকে কি বিবিসি-র তৈরি করা ছিল ঠিক এই মুহূর্তটার জন্য? ক্রিজে তাঁর বহু দিনের সঙ্গীকে ঠিক পাঁচ বল বাদে রাহুল দেখলেন দুঃস্বপ্নের আউট হতে! ওই অফ ব্রেকটায় পিছনে যাওয়ার কথা। তিনিতেন্ডুলকর কি না ব্যাট বাড়িয়ে দিলেন শরীর থেকে দূরে। ফুটওয়ার্কে তাঁর এত গন্ডগোল হচ্ছে যে, ভাবাই যায় না। ব্যাটসম্যানের যা প্রধান অস্ত্র, সেই মাসল মেমরি ঠিকই রয়েছে। পা-টা যেন কাজ করছে না। এত বিশ্রী এ দিনও তাঁর আউট হওয়ার ভঙ্গি যে, আবেগে এমন ভিজে থাকা ইডেনও যথাযথ ফিরতি সংবর্ধনা দিল না।
মিনিট দশেক বাদে কমেন্ট্রি বক্স থেকে রাহুল নেমে এলেন জনতার তীব্র আওয়াজের মধ্যে, রাহুল...রাহুল। ক্রিকেট জনতার কাছে তিনি এবং লক্ষ্মণ এখন সেই দুই ক্রিকেটারের প্রতিমূর্তি, যাঁরা সরে গিয়ে অপরাজিত। শনিবার এক রকম নিশ্চিত হওয়া গেল, সচিন তেন্ডুলকরেরও ভেবে দেখার সময় হয়েছে। তিনি কি চান ফিরে আসার সময় নির্বাক শোকে মূক ক্রিকেট মাঠ? নাকি অবসরপ্রাপ্ত হয়েও যখন যেখানে যাবেন ‘স্যাচিন...স্যাচিন’ সমারোহ? রান হয়তো আবার পাবেন। কিন্তু রান তালিকায় এই যে রবিচন্দ্রন অশ্বিনও তাঁর চেয়ে অনেক এগিয়ে, তাঁর গড় ২২, অশ্বিনের ৫১। এই ঝুঁকিটা নেওয়ার কোনও প্রয়োজন আছে? টিম ইন্ডিয়ার নতুন প্রোমোটার যিনিই হোন, তেন্ডুলকরকে রেখে জেনারেশন ওয়াই-এর দল গড়বেন? না তাঁকে বাইরে রেখে? ২০১৩-র ভারতীয় ক্রিকেটে অবশ্যই নিতে হবে সিদ্ধান্তের মধ্যে এটা যে প্রথম পড়ছে সেটাও তো মর্মান্তিক! |