ত্রিফলার পরে এ বার সোনার চেন এবং পদক। তাড়াহুড়োর যুক্তিতে বিনা টেন্ডারে কলকাতা পুরসভার বরাত দেওয়ার ঘটনা ফের প্রকাশ্যে।
কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর) এ বছর ২৭ মে আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়। ২৯ মে ইডেনে বিজয়ী নাইটদের সোনার চেন এবং পদক দিয়ে সংবর্ধনা দেয় কলকাতা পুরসভা। জাঁকজমক সহকারে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানও হয়। ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক কারা ছিল, ক’টা সোনার চেন কেনা হয়েছিল, সেগুলি কিনতে টেন্ডার ডাকা হয়েছিল কিনা এবং তাতে কত খরচ হয়েছিল, সেই টাকা কোথা থেকে দেওয়া হয়েছিল, কেকেআর-এর ক’জন এবং কারা সোনার চেন পেয়েছিলেন ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী জানতে চেয়েছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র অভিষেক মোদক। তাঁকে পুর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরাই ইডেনের ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন। সোনার চেন এবং পদক মিলিয়ে ২৫টি সামগ্রী কেনা হয়েছিল। প্রতিটি চেন এবং পদকের ওজন ছিল যথাক্রমে ২৬.৯৯ গ্রাম এবং ২৬.৬৮ গ্রাম। ওই চেন এবং পদকগুলি কিনতে খরচ হয়েছিল ৪৫ লক্ষ ৬৬ হাজার ৮৫০ টাকা।
পুর কর্তৃপক্ষই প্রশ্নকর্তাকে জানিয়েছেন, চেন-পদকের সেই টাকা দেওয়া হয়েছিল মেয়রের তহবিল থেকে। কিন্তু গোটা কেনাকাটায় কোনও টেন্ডার ডাকা হয়নি। কারণ, কেকেআর-কে সংবর্ধনা দেওয়ার তাড়ায় টেন্ডার ডাকার সময় ছিল না। তা ছাড়া, সোনা নির্দিষ্ট দরে বিক্রি হয়। তাই টেন্ডার ছাড়াই ‘বি সি সেন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি গয়নার দোকান থেকে ওই সোনার চেনগুলি কেনা হয়েছিল। চেনগুলির মানের দিকে নজর রাখতেই ওই দোকানটি বাছা হয়েছিল।
এই প্রেক্ষিতে অভিষেকের প্রশ্ন, “কেকেআর-কে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য অত তাড়াহুড়ো করার কী ছিল?” ওই ছাত্রের আরও বক্তব্য, “কলকাতা পুর আইন মোতাবেক, শুধু পুরসভা বা নাগরিকদের ক্ষতি বা জনগণের সম্পত্তির ক্ষয় মোকাবিলাতেই জরুরি ভিত্তিতে বিনা টেন্ডারে বরাত দেওয়া যায়। সুতরাং, কেকেআর-এর সংবর্ধনার ক্ষেত্রে পুর আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।” অভিষেক আরও জানান, পুর আইন অনুযায়ী, পুরসভাকে পাঁচ লক্ষ টাকার উপরে কিন্তু এক কোটি টাকার নীচে খরচ করতে হলে মেয়র পারিষদের বৈঠকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একমাত্র ‘জরুরি’ ক্ষেত্রে খরচ করার পরে মেয়র পারিষদের বৈঠকে তা অনুমোদন করানোর সুযোগ থাকে। কিন্তু ওই সোনার চেনগুলি কেনার আগে মেয়র পারিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অভিষেক বলেন, “গত ২৮ সেপ্টেম্বর মেয়র পারিষদের বৈঠকে ওই খরচ অনুমোদন করানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও পুর আইন মানা হয়নি।”
প্রসঙ্গত, গত ২০ জুন পুরসভায় প্রশ্নের জবাবে মেয়র জানিয়েছিলেন, ‘ডেকরেটার, প্যান্ডেল, বিভিন্ন শিল্পীরা যে গান গেয়েছিলেন, বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, বিভিন্ন প্রাইজ ইত্যাদি প্রসেস করা হয়েছিল, সমস্ত কিছুর বিলিং প্রসেস শেষ হয়ে গেলেই আমরা জানিয়ে দিতে পারব।’ যা থেকে স্পষ্ট সোনার চেন কেনার খরচের পাশাপাশি ওই অনুষ্ঠানের অন্যান্য কাজেও পুরসভা অর্থব্যয় করেছিল।
টেন্ডারের প্রশ্নে কলকাতা পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী রূপা বাগচি বলেন, “পুর আইন মানা এবং স্বচ্ছতা রক্ষাদু’দিক থেকেই ওই টেন্ডার ডাকা উচিত ছিল।” রূপাদেবীর আরও প্রশ্ন, “কলকাতা পুরসভায় অর্থসঙ্কট চলছে। সেখানে খেলোয়াড়দের উপহার বাবদ ৪৫ লক্ষ ৬৬ হাজার ৮৫০ টাকা খরচ করা কি শোভন? গরিব, বস্তিবাসীদের জীবনের মানের উন্নয়ন না কি বিনোদন কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?” মেয়রের তহবিল থেকে কি বিনোদনের জন্য এত টাকা খরচ করা যায়? কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের মত, “গরিব মানুষের দুরবস্থায় মেয়রের তহবিল থেকে সাহায্য করাই প্রথা ছিল। বর্তমান পুরসভা মেয়রের তহবিল থেকে বিনোদনের জন্য খরচ করে থাকলে, তা নতুন দৃষ্টান্ত!”
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “তাড়া ছিল বলেই কেকেআর-এর জন্য সোনার চেন কিনতে টেন্ডার ডাকা হয়নি। আর মেয়রের তহবিল থেকে আগে এই ধরনের কাজে টাকা দেওয়ার নজির না-থাকলে এখনও তা করা যাবে না, সেটা কোথায় বলা আছে?” |