ফিরে দেখা
আজও তাঁদের তাড়া
করে সেই দুঃস্বপ্নের রাত
কাশির দমকে রাতে মাঝেমধ্যেই ঘুম ভেঙে যায় শঙ্কর মাঝির। আর সঙ্গে-সঙ্গে ধাক্কা মারে এক বছর আগের সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। পঞ্চাননতলা বস্তির সদ্য যুবা শঙ্করের মনে পড়ে যায়, ধোঁয়া গিলতে গিলতে সেই অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় ওঠা। “এক-একটা কেবিনের কাচ ভেঙে অশক্ত মানুষগুলোকে ঠেলে জানলার ধারে নিয়ে যাচ্ছি। মইয়ে করে তাদের নামানো হচ্ছে। এক সময়ে নিজেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।”
ওই বস্তিরই আর এক বাসিন্দা অসীমা হালদার বলছেন, “শ্বাসকষ্ট আর কাশি বোধহয় আমার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। ওই ঘটনার পর থেকেই এমন অবস্থা।” অসীমা আমরির নার্স ছিলেন। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে ডিউটির সময়ে চারতলার ধোঁয়ায় ঢাকা কেবিনের দু’জন রোগীকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। তার পরে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। শঙ্কর ও অসীমা, দু’জনকেই পরে উদ্ধার করে দমকল। দীর্ঘ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তাঁরা। দু’জনকেই এখনও নিয়ম করে ওষুধ খেতে হয়।
শঙ্কর আর অসীমার সঙ্গে দুঃস্বপ্নের সেই বোঝা বইছেন ওই বস্তির আরও অনেকেই। অক্ষয় লাল, সত্যজিৎ দে, দীপক মণ্ডল, শানু দে, সানি মণ্ড ও ঋভু সরকারেরাও সে দিনের সেই ভয়াবহতার সাক্ষী। তাঁরা প্রত্যেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ধোঁয়ার গ্রাস থেকে রোগীদের বাঁচাতে। কিছু মানুষকে বাঁচাতে পেরেছেন। যাঁদের পারেননি, তাঁদের মৃতদেহের মিছিল গিয়েছে তাঁদের সামনে দিয়েই। কলকাতা তো বটেই, বিশ্বের যে কোনও হাসপাতালে বিরল ওই অগ্নিকাণ্ডের সৌজন্যে শিরোনামে উঠে এসেছিল লাগোয়া পঞ্চাননতলা বস্তি। এক বছর বাদেও সেই ঘটনার ছায়া থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা বেরিয়ে আসতে পারেননি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে পড়ে যায় মুমূর্ষুর আর্তনাদ। শেষ মুহূর্তে রোগীদের ছটফটানি।

পঞ্চাননতলার সেই যুবকেরা। শুক্রবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
বস্তির এক যুবক পঙ্কজ মণ্ডল দোকানে কাজ করেন। বললেন, “স্ট্রেচারে শুইয়ে নিয়ে যাচ্ছি, চোখের সামনে এক মহিলাকে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলাম। সে স্মৃতি কি ভোলা যায়?” আর এক যুবক পল্টু হালদার বলেন, “ধোঁয়ার মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে একটা কেবিনে ঢুকে দেখি, খাবি খাচ্ছেন এক বয়স্ক রোগী। অনেককে বাঁচাতে পারলেও তাঁকে বার করতে পারিনি। কী ভাবে ভুলব ওই রাতের কথা” হাসপাতালের কেবিনের ধোঁয়ার বিষ শরীরে ঢুকে ওই যুবকদের অনেকেই অসুস্থ থেকে গিয়েছেন। সেই সঙ্গে বরাবরের মতো ছাপ রেখে গিয়েছে দুঃসহ স্মৃতি। আগামী কাল, আমরি-কাণ্ডের বর্ষপূর্তির দিন সেই স্মৃতির সরণি ধরেই অতীতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে পঞ্চাননতলা বস্তি। অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের স্মরণে এক সভার আয়োজন করেছেন তাঁরা।
আমরি-র ঘটনা পঞ্চাননতলায় রেখে গিয়েছে চাপা ক্ষোভ ও বিভ্রান্তিও। যাদবপুরের কিশোর ভারতী স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে ওই অঞ্চলের ৬৬ জন যুবকের নাম ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহসিকতার জন্য তাঁদের ৫০০০ টাকা পুরষ্কার ও মেডেল দেওয়া হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত তালিকা ও পুলিশের পেশ করা তালিকার মধ্যে গরমিল ছিল বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। সাহসিকতার জন্য কয়েক জনকে গ্রিন পুলিশে চাকরিও দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বঞ্চনার ক্ষোভ রয়েই গিয়েছে।
এলাকারই এক যুবক রাজু দত্তের অভিযোগ, “যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েক জন ওই রাতে আমরিতে ছিলই না। অথচ, জীবন বিপন্ন করে যারা কাজ করল তাদের অনেককেই কেউ মনে রাখল না।” দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খানের বক্তব্য, “এ বিষয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।” মন্ত্রীর এই মন্তব্যে রীতিমতো অপমানিত বোধ করছেন পঞ্চাননতলার যুবকেরা। তাঁদেরই এক জন বললেন, “আমরা পুরষ্কার বা চাকরির লোভে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়িনি। ফের এমন ঘটনা ঘটলে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব।”
পঞ্চাননতলা এক সুরে বলেছে, “আমরা কোথাও কোনও অভিযোগ করব না। সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করক। আমরা এটুকুই শুধু চাই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.