আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলছে না কোনও পক্ষই। কিন্তু বিধানসভার অন্দরে বিষয়ভিত্তিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই সরকারকে কোণঠাসা করার দিকে এগোচ্ছে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস। স্বল্পকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনে দুই শিবিরের পরিষদীয় বৈঠকের পরে এই বোঝাপড়া আরও স্পষ্ট হয়েছে।
বাম ও কংগ্রেস, দুই শিবিরের নেতারাই শুক্রবার জানিয়েছেন, তাঁরা পৃথক ভাবে বেসরকারি প্রস্তাব আনবেন আলোচনার জন্য। কিন্তু পাশাপাশিই সিপিএম নেতৃত্বের পরিকল্পনা, কংগ্রেস যে বিষয়ে প্রস্তাব আনবে, তাঁরা সেই বিষয়েই ফের প্রস্তাব জমা না-দিয়ে অন্য প্রশ্নে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। আবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, তেহট্ট ও লোবায় গুলিচালনার ঘটনা, হলদিয়া-কাণ্ড, ত্রিফলা দুর্নীতি, শিল্প ও বিনিয়োগের দুরবস্থা, সরকার পরিচালনার সর্ব স্তরে গণতন্ত্রের নামে দলতন্ত্র এই রকম সব বিষয়ে কংগ্রেস ও বাম, দু’পক্ষই স্বল্প সময়ের অধিবেশনে একগুচ্ছ মুলতবি প্রস্তাব আনবে। অন্যান্য বার স্পিকার তাঁদের দাবি না-মানলে বাম বিধায়কেরা ওয়াকআউট করতেন। এ বার বামেদের পরিষদীয় বৈঠকে ঠিক হয়েছে, কক্ষত্যাগ করার দিকে না-গিয়ে তারা চেষ্টা চালাবে, কী ভাবে সরকারকে তাদের কথা শুনতে বাধ্য করা যায়। যে হেতু কংগ্রেসও এ বার বিরোধী আসনে গলা চড়াবে, তাই কক্ষের ভিতরেই প্রতিবাদ ধারালো করার কৌশল নিচ্ছে বামেরা।
বিষয়ভিত্তিক সমঝোতার অঙ্গ হিসাবেই সিপিএম এবং কংগ্রেসের দুই প্রবীণতম বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা ও জ্ঞানসিংহ সোহনপালের (চাচা) মধ্যে এ দিন ঘরোয়া আলোচনাও হয়েছে। রেজ্জাকই কংগ্রেসের পরিষদীয় কক্ষে চাচার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন।
সুযোগ পেলে সোমবার তিনি কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবের সঙ্গেও কথা বলতে চান। রেজ্জাকের যুক্তি, বিরোধী পক্ষের মোট প্রাপ্য সময় এ বার কংগ্রেস ও বামের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। তাই একই বিষয়ে দু’দলের সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
এই পরিস্থিতিতে শাসক দলও কেন্দ্রীয় পরিবেশ আইনের কড়াকড়ির জন্য হলদিয়ায় বিনিয়োগ আসছে না, এই মর্মে পাল্টা বেসরকারি প্রস্তাব এনে বিরোধীদের পরখ করতে চায়। পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “হলদিয়ায় পরিবেশগত নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানাতে আমরা প্রস্তাব আনছি।” কেন্দ্র-বিরোধী এই প্রস্তাবে বাম ও কংগ্রেস কী অবস্থান নেয়, তা দেখার জন্যই এই কৌশল নিচ্ছে তৃণমূল। তবে পার্থবাবু পরিষ্কার জানিয়েছেন, বিভিন্ন দলের তরফে যত বেসরকারি প্রস্তাবই আসুক, আলোচনা হবে ১৯৪ ধারায়। অর্থাৎ ভোটাভুটি সেখানে হবে না।
কংগ্রেস ও বাম পরিষদীয় বৈঠকে এ দিন দু’দলের রণকৌশল আলোচনা হয়েছে। দলীয় বিধায়কদের নিয়ে বৈঠকের পরে সোহরাব এ দিন বলেছেন, “আমরা প্রকৃত বিরোধীর ভূমিকা পালন করব। তার জন্য হাইকম্যান্ডের সবুজ সঙ্কেত পেয়েছি। বিধানসভার ভিতরে কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে একই কথা বলতে পারি। কিন্তু বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কিছু করব না এবং কক্ষ সমন্বয়ও হবে না।”
সোহরাব যেমন বিষয়ভিত্তিক সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়েছেন, বাম পরিষদীয় বৈঠকের পরে প্রায় একই সুরে সিপিএমের বিধায়ক আনিসুর রহমানও বলেছেন, “আমরা তৃণমূল-বিরোধী, কংগ্রেসেরও বিরোধী। কিন্তু ঘটনাক্রমে রাজ্যের স্বার্থে কোনও বিষয় এলে সহমত হতে পারি। সংসদে বিজেপি বলছে বলে কি আমরা এফডিআই নিয়ে বলিনি?” আনিসুরের বক্তব্য, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করে কক্ষ সমন্বয় বলতে যা বোঝায়, তা তাঁরা করছেন না। কিন্তু সময় ভাগাভাগির দিকে নজর রেখে কৌশলগত সহমত গড়ে উঠতে পারে।
তৃণমূলকে চাপে রাখতে বিধানসভার ভিতরে কৌশলগত ভাবে যদি বাম-কংগ্রেসের নৈকট্য হয়ে থাকে, একই সঙ্গে বিজেপি-বাম-তৃণমূলকে এক বন্ধনীতে এনে কংগ্রেসের পাল্টা রাজনৈতিক প্রচারও চলবে। কংগ্রেসের বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার কথায়, “অন্ধ কংগ্রেস-বিরোধিতায় সিপিএম-বিজেপি-তৃণমূল এক হয়েছে সংসদে! কমিউনিস্ট-বিরোধীদের বলব, দেখে নিন! সংখ্যালঘুদের বলব, সতর্ক হন! এর প্রভাব পড়বে পরিষদীয় রাজনীতিতে।” |