রাজ্যের পরিবেশ খুব ভাল বলে আবার অভয় দিলেন তিনি। আইআইটি প্রাক্তনীদের মহাসম্মেলনের আসরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর্জি রাখলেন, জন্মভূমির কথা ভাবুন! সবাইকে এ রাজ্যে লগ্নি করতে বলুন!
কিন্তু কীসের ভিত্তিতে প্রমাণ করা যাবে রাজ্যে শিল্পবন্ধু পরিবেশ রয়েছে, আর কীসের ভিত্তিতেই বা শিল্পপতিরা এ রাজ্যে আসার আস্থা খুঁজে পাবেন তার কোনও স্পষ্ট দিশা এ দিনও যথারীতি অনুচ্চারিত থেকে গেল মুখ্যমন্ত্রীর কথায়।
এ রাজ্যে বিনিয়োগের প্রশ্নে শিল্পমহলের প্রধান সংশয় মূলত দু’টি। প্রথমত, রাজ্যের শিল্পনীতির কোনও নির্দিষ্ট রূপরেখা তাঁদের সামনে নেই। বিশেষত জমি পাওয়ার প্রশ্নে বড়সড় অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ, মমতা ঘোষণা করে দিয়েছেন, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না রাজ্য সরকার। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনে ছাড়ের প্রশ্নেও কোনও সার্বিক নীতি নেই। দ্বিতীয়ত, পরিবেশগত অস্থিরতা আর দলীয় জুলুমবাজির প্রকোপে রাজ্যের ভাবমূর্তি নিয়ে একের পর এক নেতিবাচক বার্তা গিয়েছে বলে মনে করে শিল্পমহল। তাদের বক্তব্য, কোথাও সিন্ডিকেট, কোথাও তোলাবাজি, কোথাও প্রশাসনিক ঢিলেমির অভিযোগ রাজ্যের শিল্পচিত্রে আরও সঙ্কট বাড়িয়েছে। কিন্তু বিজয়া সম্মেলনী হোক বা হস্তশিল্পমেলার মঞ্চই হোক বা এ দিন আইআইটি প্রাক্তনীদের সম্মেলনই হোক, মুখ্যমন্ত্রী সর্বত্রই বলছেন, রাজ্য লগ্নি টানতে আগ্রহী। বলছেন, এ রাজ্যে শিল্প গড়ার মতো পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু কোথাওই মূল সমস্যাগুলো নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন না বলে শিল্পমহলের মত। |
এ দিনও যেমন জমি-নীতি প্রসঙ্গে কার্যত কিছুই বললেন না মমতা। জমিব্যাঙ্কের প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে গেলেন। কিন্তু সেই জমিব্যাঙ্ক থেকে এক লপ্তে বড় জমি পাওয়া নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে, সে ব্যাপারে নীরব থাকলেন। এ দিন বরং তাঁর কথায় অনেক বেশি জায়গা পেল রাজ্যের শিল্প-পরিবেশের প্রসঙ্গ। লগ্নি করার জন্য যে আস্থাবহ পরিবেশ প্রয়োজন, এ রাজ্যে তার অনুপস্থিতি নিয়ে বারবারই সরব হয়েছে শিল্পমহল। এ দিন তারই উত্তর দিতে চেয়েছেন মমতা। বলেছেন, “কিছু রাজনৈতিক সমস্যা থাকতে পারে। সেটা গণতান্ত্রিক দেশে থাকেই। তা বলে বলবেন না যেন যে, এখানে অনেক সমস্যা, লগ্নি করতে পারব না।” মমতার দাবি পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ শান্ত, বিনিয়োগের উপযুক্ত। দার্জিলিং, জঙ্গলমহলে অশান্তি নেই। হরতাল-ধর্মঘটে শ্রমদিবস নষ্ট হওয়ার হার কমেছে। বাম আমলের বিপুল করের বোঝায় নড়বড়ে কোষাগার নিয়েও রাজ্যের আর্থিক উন্নয়নের হার বেড়েছে (মমতার বক্তব্য, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষের প্রথম ভাগে রাজ্যের জিডিপি জাতীয় জিডিপি-র চেয়ে বেশি ছিল)। শ্রোতারা মুখ্যমন্ত্রীর আবেগকে সম্মান করেছেন। কিন্তু শিল্পপতিদের আস্থা ফেরানোর জন্য সরকার কী করছে, তার জবাব পাননি।
শিল্প মহলেরই মতে, মমতা নিজেও সম্ভবত বুঝতে পারছেন, এ রাজ্যে বড় শিল্প টানাটা কতটা কঠিন হয়ে গিয়েছে। সেই কারণে হস্তশিল্প মেলার উদ্বোধনে যা বলেছিলেন, এ দিন তারই প্রতিধ্বনি করেছেন তিনি। বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি না যে, বড় শিল্পই শুধু অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পারে। ছোট শিল্পও পারে।” ঠিক যে ভাবে মিলন মেলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “বড় শিল্প অনেকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ক্ষুদ্রশিল্পকেই আঁকড়ে বিশ্ববাজার ধরবে এ রাজ্য।”
মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতার সময় একাধিক বার হাততালি পড়েছে। তাঁর আবেগঘন কথা শুনে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন সম্মেলনের চেয়ারম্যান সন্দীপন চক্রবর্তী, উপদেষ্টা সংস্থার কর্তা পার্থ ঘোষ প্রমুখ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আবেগ নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও অনেকেরই বক্তব্য, রাজ্যে শিল্পায়নের সম্ভাবনা ও সরকারি সাহায্যের আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারতেন মুখ্যমন্ত্রী। মুম্বই আইআইটি-র প্রাক্তনী সতীশ কিনি যেমন বললেন, “উনি হয়তো চেষ্টা করছেন রাজ্যের ভাবমূর্তি বদলানোর। যার কিছুটা দেখা গিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানার শেষ দিকে। কিন্তু লগ্নির জন্য চাই আরও কিছু নির্দিষ্ট তথ্য। টাটা-র বিদায়ের দায় রয়েছে ওঁদের উপর।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেকে তাঁর সঙ্গে সহমত। তাঁদের কথায়, মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তা অনেকটাই ভাসা ভাসা। শিল্পের প্রশ্নে সরকারের কাছে যে স্পষ্ট, স্বচ্ছ দিশা পেতে চাইছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ, সেটাই মিলছে না বলে ওঁদের মত।
আইআইটি প্রাক্তনীদের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি, “আমাদের হয়ে লবি করুন। বোঝান।” উপস্থিত সকলকে উপহার (রাজ্যের চাল, দার্জিলিং চা ও চটের ব্যাগ) দিয়ে হাততালিও কুড়িয়েছেন বিস্তর। কিন্তু শিল্প নিয়ে ধোঁয়াশা, যে তিমিরে সে তিমিরেই। |