|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ভুল ভাঙবার সময় এসেছে |
প্রবাল দাশগুপ্ত |
দ্য মাওইস্টস ইন ইন্ডিয়া: ট্রাইবালস আন্ডার সিজ, নির্মলাংশু মুখোপাধ্যায়। প্লুটো প্রেস (লন্ডন/ নিউইয়র্ক), মূল্য অনুল্লেখিত |
রাষ্ট্র বনাম মাওবাদীবৃন্দ? এ রকম সুসজ্জিত দুটো বাহিনীতে সবাইকে ফেলতে চাওয়া মানে অস্ত্রে শাণ দেওয়া। ‘তুমি আমাদের পক্ষে না ওদের পক্ষে?’ প্রশ্নটা যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল। উগ্র রাষ্ট্রপন্থীর সঙ্গে উগ্র মাওবাদীর একটা মস্ত মিল হল ‘আমরা-ওরা’-র বনামবিদ্ধ চিন্তাভঙ্গিতে আরাম পাওয়া। এই বাহিনীবদ্ধতাই কি ‘ভারতের মাওবাদী সমস্যা’ সমাধানের পথে প্রধান অন্তরায়? নির্মলাংশু মুখোপাধ্যায় তাই মনে করেন।
তিনি কলম ধরেছেন সুধীবৃন্দের কাছে আবেদন জানাতে। অতিসরল চিন্তার আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা যেন সংবাদপত্রের চিৎকৃত হেডলাইনের পাশ কাটিয়ে সাধারণ পাঠকদেরও জানিয়ে দেন কী কী বিকল্পের কথা ভাববার মানে হয়। নইলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে আলোচনা করে বাস্তবসম্মত মীমাংসার সূত্র বার করবে কে?
কথা শুরু করেছেন সেই সব একপেশে খোলা চিঠি থেকে যাতে দেশবিদেশের সুধীবৃন্দ সই করেও ফেলেন। তাঁরা জানেন না আদিবাসীদের সমস্যার সঙ্গে জঙ্গিরা কী ভাবে কতটা জড়িয়ে গেছেন। শহর থেকে যে-স্বপ্নাবিষ্টরা মাওবাদীদের ঘাঁটিতে বেড়াতে যান, পৌর্বাপর্যজ্ঞানের অভাববশত তাঁদের প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর। নির্মলাংশু তাই অনেকেরই অজানা কিছু খবর দিয়েছেন।
ষাটের দশকে সহপথিকদের সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে ব্যক্তিগত মুণ্ডচ্ছেদের পথে হেঁটে কোনও কোনও উগ্রপন্থী গোটা নকশাল আন্দোলনেরই বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছিল। সেই ‘মাওবাদী’রাই কী ভাবে নতুন ফৌজ তৈরির উদ্দেশ্যে জঙ্গলের ভিতরে ঘাঁটি খুঁজে নেয়, তার কাহিনি খুলে বলেছেন নির্মলাংশু। এরা আদিবাসীদের খানিকটা আস্থা অর্জন করে তাদের শিশুদের লেখাপড়ার সঙ্গে মিশিয়ে উগ্রপন্থী মতাদর্শ আর লড়াইয়ের কায়দা শিখিয়ে দেয়। সেই একদা-শিশুরাই আজ মাওবাদীদের ফৌজ; অনেকেই এখনও নাবালক। সমবায়ের সঙ্গে যে-ঘনিষ্ঠতা অর্জন করলে দলে দলে সাবালক আদিবাসীও অতিবাম মতাদর্শে দীক্ষা নিত তা এরা পারেনি। শিক্ষায় স্বাস্থ্যে পুষ্টিতে আদিবাসীদের অগ্রগতির জোয়ার এলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু অরুন্ধতী রায়ের মতো শহুরে সহানুভূতিশীলদের রিপোর্টসহ বিবিধ দলিল খতিয়ে দেখে নির্মলাংশুর সিদ্ধান্ত, দীর্ঘকাল-অধিকৃত এলাকাতেও ঘাঁটির ফৌজি স্বার্থটাই দেখছে মাওবাদী দল। আদিবাসীদের জনকল্যাণের বামপন্থী ব্যবস্থার রূপায়ণ এদের কর্মসূচিতেই নেই।
ওদিকে আবার আদিবাসীদের প্রতি ঔদাসীন্য ভারতের নাগরিক সমাজেও বদ্ধমূল। সরকারি মহলেও তথৈবচ। ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ওরা মূলস্রোতের সব পার্টির কাছেই নগণ্য। মাওবাদীরাও কমবয়সি আদিবাসীদের সামনে ঠেলে দিচ্ছে বিদ্রোহী ‘সৈনিক’ সাজিয়ে, শিশুদের মানবাধিকার ইত্যাদির তোয়াক্কা না রেখে। সরকারও ‘কঠিনতম অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ’ সামলাবে বলে ‘মাওবাদী মারা’র নাম করে প্রধানত আদিবাসীদেরই মারছে। মাঝেমধ্যে মীমাংসাসূত্রের সন্ধানে সংলাপের অভিনয় করে দু’পক্ষ। কিন্তু যারা সশস্ত্র সংগ্রামে জিততেই চায়, সংসদীয় গণতন্ত্রে যাদের চির-অরুচি, তাদের সঙ্গে কী-আলোচনা এগোবে?
নির্মলাংশুর প্রস্তাব, ভারতের মাওবাদীরা নেপালি সমপন্থীদের মতোই এ বার মূলস্রোতের রাজনৈতিক শক্তিবৃন্দকে বলুক, ‘সবাই যাতে আদিবাসীকল্যাণের উদ্যোগ নিতে পারি সেজন্যে আমরাও সংসদীয় প্রক্রিয়ায় যোগ দেব।’ ওরা তো আদিবাসীদের ঘনিষ্ঠ। যে কোনও দিল্লীশ্বর সমঝে চলবে; জনসমক্ষে বৈধতা হারাবে অপারেশন গ্রিনহাণ্ট। সংসদও পালটে যাবে মাওবাদীরা যোগ দিলে। আদিবাসীদের প্রগতিও হবে। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে তথ্যাধিকার-শিক্ষাধিকার আদায় করার পর জনমত অবশেষে অনুকূল। শত অস্ত্রধারণেও যা অসম্ভব ছিল সে-অর্জন আজ শান্তিপূর্ণ পন্থার নাগালের মধ্যে। সংলাপ তাই এখনই শুরু করা জরুরি। অস্ত্রত্যাগের আন্তরিক প্রস্তাবের ভিত্তিতে, কাদের মধ্যস্থ রেখে, কী রকম দরকষাকষির মাধ্যমে, হঠকারিতা থামানোর সাহস দেখিয়ে মাওবাদীরা গণতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে, সে-কর্মসূচির খুঁটিনাটি ছকেছেন নির্মলাংশু।
সুধীসাধারণের কাছে তাঁর আর্জি, শহুরে রোমাণ্টিকদের উড়ো কথায় কান দেবেন না। আদিবাসীদের উন্নয়নের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিন। যে-শান্তি উন্নয়নের পূর্বশর্ত তার দিকে যেতে বাধ্য করুন উভয় পক্ষকেই। সংলাপের বাতাবরণ তৈরি করুন। সে জন্যে আমরা-বনাম-ওরা মনোভঙ্গির বনামবিদ্ধতার জাল কেটে বেরিয়ে আসুন।
উত্তপ্ত পরিবেশে শান্তির যে কোনও উদ্যোগকে স্বাগত জানাবার দায়িত্ব থাকে ঠিকই। কিন্তু শুধুমাত্র সেই কারণে এ-প্রস্তাবে সাধুবাদ জানালে নিতান্তই দায় সারা হবে। পিছনের মলাটে চমস্কি লিখেছেন, ‘নির্মলাংশু একজন অশিথিল, বিবেচনাশীল গবেষক; এই কণ্টকিত বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ সহৃদয় এবং সুচিন্তিত।’ চমস্কির প্রতিধ্বনিই করব। দর্শনে এবং ঈক্ষাতত্ত্বে (কগ্নিটিভ সায়েন্স) নির্মলাংশু বহু দিন ধরে সুপরিচিত। তাঁর বিশ্লেষণমূলক উপস্থাপনের নৈপুণ্যের সবটাই দেখতে পাই পাণ্ডিত্যবিবর্জিত এ-পুস্তিকাতেও। একদেশদর্শিতা এড়িয়ে, একেকজনের বক্তব্যের অংশবিশেষে সায় থাকা সত্ত্বেও কিছু জায়গায় দ্বিমত ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে আলোচকের প্রতি ব্যক্তিগত পক্ষপাত আর কটাক্ষ বাদ দেওয়া যে কোনও লেখকের পক্ষেই কঠিন কাজ। এ-বইয়ের পাঠকের চোখে পড়বে যে, নির্মলাংশু যে কোনও লেখক নন। পাঠকের তাড়া আছে জানেন। তাই গল্পের সাত কাহনে যাননি। আদিবাসীদের মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকারের উপর জোর দিয়েছেন। গোষ্ঠীবিশেষের নৃতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব ঘেঁটে কারও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে কথা বাড়াননি (পৃ ১)। মাওবাদীদের সূত্রেও অসংসদীয় বামপন্থার মতাদর্শভিত্তিক উনিশ-বিশের ব্যাপারে বাক্যব্যয় করেননি একই কারণে (পৃ ২)।
উপস্থাপনরীতির খুঁটিনাটি দেখে বুঝতে পারি, অসুস্থ দেশের চিকিৎসার আশু প্রয়োজনের কথা ভেবেই উদ্দেশ্যমনস্ক পথ বেছে নিচ্ছেন। নির্মলাংশু তাই বহুপাক্ষিক কথাবার্তার উপযোগী আবহ তৈরি করতে আগ্রহী। সে-আবহ তৈরির কথা মনে রেখে আরও একটু এগোনো দরকার। বনামবিদ্ধতা থেকে সরে আসবার সূত্রেই, মানবাধিকারসহ রাষ্ট্রপুঞ্জের মূলনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, নির্মলাংশুর শান্তিপ্রস্তাবকে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে সবুজ কর্মসূচির দিকেও নজর দেওয়া ভাল। সেই সঙ্গে উঠে আসবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কথা।
পুস্তিকার সীমিত পরিসরে আলোচনার ধারা স্পষ্ট রাখবার জন্যে নির্মলাংশু আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতির কথা বাদ দিয়েছেন। দিতেই পারেন। কিন্তু বৃহত্তর আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধির স্বার্থে বিভিন্ন সহপথিকের দিকে এ বার মন দিতে হবে। পরিবেশসংকটে সারা পৃথিবী জর্জরিত। সামাল দিতে দেরি হলে সমূহ সর্বনাশ। সে-কাজের সূত্রে আদিবাসীদের সংস্কৃতি পাথেয়স্বরূপ, ভূগর্ভস্থ খনিজসহ তাদের বনসম্পদ রক্ষা করার অধিকারও তাদের সাংস্কৃতিক অধিকারের অবশ্যস্বীকার্য অঙ্গ, এ কথা রাষ্ট্রপুঞ্জের মহলেও বহুপুনরুক্ত। তাই দান্তেওয়াড়া ঘুরে এসে অরুন্ধতীর রিপোর্ট অতিসরলীকরণদোষে দুষ্ট এ কথা মেনেও জিগ্যেস করব, পরিবেশবাদী অরুন্ধতীর নর্মদাবিষয়ক বা পরমাণুবিষয়ক রচনা নিয়ে নির্মলাংশু কেন নীরব? পরিবেশ নিয়ে অন্যত্র নিজের অভিমত খুলে বলবেন বলেই কি?
গাঁধীবাদীরা যে যে-কোনও অহিংস আন্দোলনেরই অপরিহার্য মিত্রশক্তি এ কথা নির্মলাংশু লিখেছেন। কিন্তু চমস্কি নন্দীগ্রাম নিয়ে দ্বিতীয়, পরিবর্তিত বিবৃতি কেন দিয়েছিলেন সে-আলোচনার সূত্রে নির্মলাংশু আলাদা করে বলেননি যে গাঁধীবাদী অম্লান দত্তের বয়ান পড়েই চমস্কির পুনর্বিবেচনার সূত্রপাত। কিন্তু অম্লানবাবু বা তাঁর সহপথিকদের অর্থনৈতিক বীক্ষা বিভিন্ন ঘরানার বামপন্থীর যে রকমই লাগুক, সাধারণ ভাবে বিজলি-সড়ক-পানির পুঁজিনিবিড় উন্নয়নপ্রকল্পের বদলে জল-জঙ্গল-জমি-মনস্ক শ্রমনিবিড় সমবায়ী ক্রমবিকাশের বিকল্পকেই বরণ করতে হবে এ-মতে কি নির্মলাংশুর সায় নেই? ওই রকম বিকল্পের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও বিশুদ্ধ ক্ষমতার লড়াইয়ে সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে ভেবেছিলেন বামপন্থী অনেকেই। সে-ভুল আজও যদি না ভাঙে তা হলে বড় দেরি হয়ে যাবে। |
|
|
|
|
|