ঊনবিংশ শতকের ঐতিহাসিক ফরাসি উক্তিটা ফের একবার ফিরে এল। যা বলছে: প্লু সা শঁজ প্লু সেলা মেম্ শোজ। বাংলা করলেকোনও কিছু যত বদলায়, ততই যেন তা আগের মতো হয়ে যায়। কথাটা ফেরার কারণ, প্রায় তিরিশ-বত্রিশ বছরের মতো হারিয়ে গিয়ে সেই ৩৩.৩৩ স্পিডের বড়, কালো অভিজাত, প্রাণ-জুড়ানো মোড়কে ভরা দীর্ঘ বাদন, থুড়ি, লং প্লে রেকর্ড ফের ফিরে আসছে জীবনে ও গানে।
স্টারমার্ক থেকে ল্যান্ডমার্ক থেকে মিউজিক ওয়ার্ল্ড সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে এল পি রেকর্ড। ফের বিক্রি হচ্ছে রেকর্ড প্লেয়ার। কোনও কোনও শৌখিন শ্রোতা এই হুজুগে বাড়ির পুরোনো রেকর্ড প্লেয়ার সারিয়ে নিচ্ছেন। রেকর্ড প্লেয়ারের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হলেন সঞ্চালক শ্রাবন্তী মজুমদার থেকে হালের নায়িকা শ্রাবন্তী। শ্রাবন্তী মজুমদার বললেন, “আমি তো বিলেতে থাকি। সেখানে রেকর্ড প্লেয়ার কেনাটাই এখন রেওয়াজ। আমার তিনটে রেকর্ড প্লেয়ার আছে। দেশিবিদেশি মিলিয়ে রেকর্ডের সংখ্যাও অনেক।”
কী জাদু আছে রেকর্ড প্লেয়ারে বা গ্রামাফোনে?
মাদকতা মাখানো স্বরে শ্রাবন্তী মজুমদার বললেন, “রেকর্ড প্লেয়ারে যখন এল পি বা ই পি রেকর্ড শুনি তখন তার সুরের ‘সোল’টাই অন্য রকম হয়। গায়কের কণ্ঠস্বর, তাঁর সুর, কিংবা বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা সবটাই আশ্চর্য মায়াবী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সিডিতে বা ক্যাসেটে গান শুনলে মনে হয় সব কিছু যেন বড্ড নিখুঁত হচ্ছে। খুব নিখুঁত কোনও কিছুর মধ্যে এক ধরনের যান্ত্রিকতা থাকে সেটাই সিডি অ্যালবামের বা সিডি প্লেয়ারের খামতির দিক।” অন্য দিকে নায়িকা শ্রবান্তী তো বেজায় খুশি এই শুনে যে পুরোনো রেকর্ড প্লেয়ার ফের কলেবরে ফিরে এসেছে। “আমার জেঠুর একটা পেল্লাই চোঙাওয়ালা গ্রামাফোন ছিল। মাঝে মাঝেই ভাবতাম সেটা চালাব। কিন্তু চালানোই হয়নি কোনও দিন। রেকর্ডের চল ফিরে আসছে শুনে খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওই রকম একটা গ্রামাফোন কেনার। ভাল ভাল গান শোনা যাবে সারা ঘর ছড়িয়ে, তাতে বাড়ির পরিবেশটা পাল্টে যাবে। আর ঘর সাজানোও হবে। হাজার হোক গ্রামাফোনের মধ্যে একটা আলাদা আভিজাত্য আছে তো। সেটা সিডি বা ডিভিডি প্লেয়ারে নেই। সবাই যে আবার রেকর্ড শুনছে সেটা ভেবেই থ্রিলিং লাগছে।” |
লং প্লে শোনার মধ্যে আসলে একটা বুঁদ হওয়ার ব্যাপার ছিল, কিন্তু সেটা ছিল পাঁচ জনে মিলে একযোগে বুঁদ হওয়ার ব্যাপার। এ বাড়ির বসার ঘরে লং প্লে চললে পাশের বাড়ির বারান্দায় কান পেতে বসতেন কেউ কেউ। লং প্লে আসার পরে এই সুখের গৃহকোণটা আরেকটু ছড়িয়ে একটা ড্রইং রুম স্টেটাস পেল। যে-যে বাড়িতে সন্ধেবেলায় লং প্লে চলত, আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়ায় তাদের হেভি কেতা ছিল।
বুককেসে কিছু রচনাবলি-টলির সঙ্গে জ্যাকেটে-পোরা এলপি ডিস্ক দিয়ে বসার ঘর সাজানোর স্টাইল হয়েছিল ষাটের দশকে। সবচেয়ে মজে গিয়েছিলেন ক্ল্যাসিকাল মিউজিক ভক্তরা, কী ভারতীয় কী ওয়েস্টার্ন। সত্যজিৎ রায় তো বলতেনই, ‘আমি লং প্লে শোনার অভ্যেসের বাইরে বেরোতেই পারিনি’।
এল পি-তে হেমন্ত সুচিত্রা কণিকার গলায় রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের গান শোনার সময় কত বারই মনে হয়েছে মানুষগুলো আমার ঘরেই বসে, রক্তমাংসে। আবার আমির খানের মাড়োয়া বা হংসধ্বনি শুনতে শুনতে ভুলেই গেছি আমি কোথায়। আর আজও ভুলিনি আমাদের উল্টো পিঠের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধুর ফ্ল্যাটে বসে চোখ ভ’রে প্রাণ ভ’রে দেখা সেই সব লং প্লে মলাট, যাতে শোভা পাচ্ছে ন্যাট কিং কোল, প্যাট বুন, এলভিস কিংবা ক্লিফ রিচার্ডের মুখ। গান, বাজনা বা কন্ডাক্টিং শুনতাম ঠায় চোখের সামনে প্রচ্ছদটাকে মেলে ধরে। এ ভাবেই এক কালে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম ফরাসি নায়ক-গায়ক ইভ্ মঁতঁ-র।
লং প্লে-র ছেলেমেয়ে তো বটেই, শুধুই কি গান শুনে শুনে, প্রচ্ছদ পড়ে পড়ে নয়? কত পাশ্চাত্য এলপি-র জ্যাকেট লিটারেচর পড়ে পড়েই সন্ধে কেটে গিয়েছে আমার। শ্নাইডরহানের বাজানো মোৎজার্টের পিয়ানো কনচের্তোর কভারে যা মুদ্রিত তথ্য দেওয়া আছে তা প্রতি বার পড়ার পর একটা নতুন প্রেক্ষিত জন্মায় বাজনাটার। আর আমার একটি ফ্লামেঙ্কো ডিস্কের কভারে কয়েক হাজার শব্দের ইতিহাস আছে স্প্যানিশ ফ্লামেঙ্কোর। তবে প্যারিসের বই ও রেকর্ডের দোকান ফ্ল্যাক-এ যে অভিজ্ঞতা এসেছে লং প্লে শুনে, তা জন্ম-জন্মান্তরেও ভোলার নয়। লেখক অ্যালবার্ট কামু পড়ছেন তাঁর ‘দ্য আউটসাইডার’ উপন্যাস, সেই রেকর্ড চালিয়ে কানে হেডফোন দিয়ে শুনছি, হাতে সেই বইয়ের পাতা খোলা। লং প্লে-তে এ রকম আরেক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা রিচার্ড বার্টন ও পিটার ও’টুল-এর পড়া ডিলান টমাস-এর কাব্যনাট্য ‘আন্ডার মিল্কউড’।
আসলে, লং প্লে ডিস্ক নিজস্ব একটা সংস্কৃতিই গড়ে নিয়েছিল। একটা লম্বা সফরের সংস্কৃতি। কানে হেডফোন গুঁজে জগৎকে ভুলে থাকার রেওয়াজ নয়, জগৎকে সঙ্গে নিয়ে মজে যাওয়ার কারবার। বাল্যে পাড়ার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের রেডিওগ্রাম ও গ্যারার্ড চেঞ্জারের দিকে জুলজুল করে চেয়ে থাকতাম, প্রহরের পর প্রহর জুড়ে গান, যেন সুরের এক অন্তহীন শোভাযাত্রা! ওই লং প্লে রেকর্ডগুলোই যেন নিয়ন্ত্রণ করছে ওদের জীবনের গতিবিধি। আমাদের বাড়িতেও গ্রামোফোন ছিল, কিন্তু রেডিওগ্রাম নয়, আর চেঞ্জার তো নয়ই। ওই চেঞ্জারের জন্য আমি ওদের হিংসে করতাম। আমাদের বাড়িতে অনেক বই ছিল, অজস্র দিশি রেকর্ড, এমনকী বাবার প্রিয় ফ্রিৎস ক্রাইসলারের বেহালাবাদন। কিন্তু আমার বুকে ঈর্ষার আগুন ধরাত ওদের ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা, ডিন মার্টিন, জিম রিভজ, বিং ক্রসবি, টোনি ব্রেন্ট। সব থেকেও যেন আমার কিছু নেই। আমি এর প্রতিশোধ নিতাম ওদের রেকর্ড কভারের সব ছাপা কথা পড়ে ফেলে, যার ধারও ওরা ধারত না। এ ভাবেই একদিন এক বাঙালি বন্ধুর সদ্য কেনা ‘ভেরিয়েসানজ অন দ্য থিম অফ পথের পাঁচালী’ কভারে পড়লাম সত্যজিৎ রায়ের লেখা রেকর্ড পরিচিতি। আর নিজের কেনা ঋতু গুহ-র প্রথম এল পি বাড়ি এনে চালাতে গিয়ে নজরে এল সেই সত্যজিৎবাবুরই লেখা স্নিগ্ধ পরিচিতি। লং প্লে ছাপা বন্ধ হয়ে যেতে এই সীমিত কিন্তু সুখকর পড়ার জীবন থেকেও আমি বিচ্যুত হয়েছিলাম। আশা করি সেই সুদিনও ফিরে আসবে।
তবে লং প্লে-র লম্বা স্মৃতির আসল কীর্তন তো গানই। গানের প্রচারে লং প্লে-র অবদান ৭৮ ঘূর্ণনের সেই আদি, অকৃত্রিম, কৃষ্ণচক্রের পরই। কলেজে থাকতে ডায়মন্ডহারবারে পিকনিকে গিয়ে বালিয়াড়ির ওপর খোলা হাওয়ায় বাজতে শুনেছিলাম ‘গাইড’ ছবির সংলাপ-সহ গান। বাপরে, প্রায় প্রথম চুম্বনের ধাক্কা! প্রতি সুরে, প্রতি সংলাপে ফিরে ফিরে আসছে ওই অপূর্ব ছবিটির রূপ-রস-স্পর্শ।
সত্তরের দশকে হঠাৎ এক সময় যে নজরুলগীতির জোয়ার এসেছিল, তার কারণ যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম তেমনই ওই সময়েরই একটা লং প্লে ‘জেমজ অব নজরুল’। ও রকম একটা নজরুলগীতির সঙ্কলন আর হয়নি। আর কে নেই সেই চয়নে? এ বলে আমায় দ্যাখ, সে বলে আমায়। ধনঞ্জয়ের ‘ভোলে না কেউ ভোলে’ আর মানবেন্দ্রের ‘এত জল ও চোখে পাষাণী আনলে বল কে’ এই মুহূর্তে আমার কানের পাশে ঘুরছে। যেমন ঘুরছে আমার বিয়েতে পাওয়া একটা লং প্লে-র গজল ‘মুহব্বত করনেওয়ালে কম ন হোঙ্গে’। বলার দরকার হয় কি যে, গানটা মেহেদি হাসানের? গোটা দীর্ঘবাদন রেকর্ড জুড়ে মাত্র চারটে গজল, আসর থেকে তুলে আনা। নাম ‘মেহেদি হাসান ইন কনসার্ট’। বলা আরও বাহুল্য যে, আমাদের মধুযামিনী কেটেছিল এই এবং আরও কয়েকটি মেহেদি লং প্লে। আর পাশাপাশিএখন ভাবলে অবাকই লাগছেআরও একটা করুণ গানের সংগ্রহ। বেগম আখতারের ‘ইন মেমোরিয়াম’। আর তার মধ্যে বিশেষ করে কবি মীর তক্কি মীরের রচনা ‘উল্টি হো গই সব তদ্বিরে কুছ ভি দবা ন কাম কিয়া’। মধুচন্দ্রিমায় এত করুণ গান কেন? সে যুক্তি তো দিয়েই রেখেছেন কবি শেলিমধুরতম গানই তো করুণতম ভাবনা নিয়ে। আর বলে রেখেছেন তাঁর কিছু দিনের মতো ভাবশিষ্য রবীন্দ্রনাথ, যখন বললেন আমাদের বিবাহের সুখমুহূর্তে সানাইয়ের বেদনধরা সুরই সঙ্গত। যে বেদনার অবিশ্রান্ত ধারা বয়ে চলেছে কয়েক যুগ ধরে উস্তাদ বিসমিল্লা খানের সানাইয়ে। লং প্লে মানেই বিসমিল্লা। কোনও বাঙালি নেই যার লং প্লে সংগ্রহে একটা অন্তত বিসমিল্লা নেই। |