ভারতীয় শিবিরে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষের নাম এখন কী?
ইডেন টেস্টের চতুর্থ দিনের মোড়ে দাঁড়িয়ে যদি মনে হয় উত্তর সচিন তেন্ডুলকর, তা হলে দশে শূন্য পেলেন! বীরেন্দ্র সহবাগ? জিরো! জিরো!
টিম ধোনি-তে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষের নাম আপাতত রমেশ মানে। দলের অঙ্গসংবাহক। সোজা ইংরেজিতে ম্যাসিওর। শুক্রবার রাত্তিরটা মানেকাকা-র (টিমের দেওয়া ডাক নাম) খুব ব্যস্ত গেল। পরের পর কাস্টমার ঘরে। আসলে ১৬৩ ওভার ফিল্ডিং করার পর ফোর্থ ডে-তে যেখানে আরও কুড়ি-তিরিশ ওভার খাটান দিয়ে তবেই ব্যাট করতে নামা, সেখানে পরিপূর্ণ মাসাজ ও প্রয়োজনে আইএফটি মেশিনের ব্যবহার ছাড়া পেশির ক্লান্তি কাটানো অসম্ভব।
ক্লান্ত পেশিকে না হয় ম্যানেজ করা গেল। নিজেদের জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়া ম্যাচকে কী ভাবে ম্যানেজ করা যাবে? গ্রেম সোয়ান যে বাজারে অনায়াসে রিভার্স সুইপ মেরে যাচ্ছেন, সেখানে ব্যবধান অন্তত আড়াইশো রানের হওয়া উচিত। তার পর ম্যাচ বাঁচাতে হলে ব্যাট করতে হবে অন্তত পাঁচটা সেশন। পারবে ভারত দশ ঘন্টা খেলতে? যদি ‘জয় বাবা সহবাগ’ মন্ত্র কাজ করে তো করল। একটা দুর্ধর্ষ সহবাগ ইনিংস বিপক্ষকে হতোদ্যম করে দিতে পারে। অন্য দিকটা কে ধরবে? পূজারা? গম্ভীর? কোহলি? ইডেনে জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস খেলতে নামছেন তেন্ডুলকর। সেটা যেন মহানায়কোচিত হয়। এ ছাড়া অ্যাকাডেমিক গুরুত্বেরও কিছু পড়ে থাকবে তো? |
কোথাও যেন বারো বছর পর ইডেনে প্রথম হেরে সিরিজে ১-২ পিছিয়ে যাওয়ার অমঙ্গল-চিন্তা প্রথম উঁকি দিচ্ছে। অনমনীয় লড়ে ভারত ম্যাচ বাঁচাতে পারল। আর পারল না। দুটো সম্ভাবনার মাঝে অবশ্য একটা সংশয়ের নিষ্পত্তি ঘটে গিয়েছে। মুখুজ্যেবাবু আর কোনও টেস্ট ম্যাচ উইকেট করার দায়িত্ব পাবেন না। তাঁর হাঁড়িকাঠ তৈরি। নিছক সিএবি কর্তাদের হাতে ব্যাপারটা থাকলে তাঁরা এতটা চরমপন্থী হতেন কি না বলার উপায় নেই। কিন্তু বোর্ড সর্বশক্তিমান এন শ্রীনিবাসন এ দিন ক্লাব হাউসে বসে রাগত ভাবে প্রবীর মুখুজ্যের চূড়ান্ত পরোয়ানায় সই করে দিয়েছেন। তাঁকে মাঠে এ দিন স্বাগত জানায় ইশান্ত শর্মার নিজের বলে কুকের সহজ ক্যাচ মিস। পেস বোলারের পক্ষে রিটার্ন ক্যাচ নেওয়া তুলনামূলক ভাবে কঠিন। যেহেতু তার শরীরের ভারসাম্য তীব্র গতির সঙ্গে এক দিকে হেলে থাকে। কিন্তু শুক্রবার সকালে ইশান্তেরটা তো ছিল ‘এসো খোকন, তোমায় ক্যাচ ধরা শেখাই’ পর্যায়ভুক্ত। ধরার চেয়ে ফেলা কঠিন।
শ্রীনিবাসন নির্বাচক বা টিম ম্যানেজমেন্টের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারতেন। বলতে পারতেন, মধ্যিখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে কোনও পারফরম্যান্স ছাড়া এই ছেলেটাকে নিলে কেন তোমরা? বা ধোনি, আক্রমণে যুবরাজকে আনার জন্য ১২১ ওভার অবধি অপেক্ষা করলে কেন? পার্টটাইম বোলার তত্ত্বটাই তো তুমি গুলিয়ে দিচ্ছ।
শ্রীনিবাসন সে সব কিছুই বলেননি। তীব্র কষাঘাতের সুরে বরং বলে যান, “খুব ভাল ওয়ানডে উইকেট হয়েছে।” দু’এক জন কর্তাকে এমনও আভাস দিয়ে যান যে, জাতীয় ক্রিকেট স্বার্থবিরোধী পিচ তৈরি করার অপরাধে মুখুজ্যেকে অবিলম্বে ছাঁটতে হবে। নইলে সিএবি-কেও ছেড়ে কথা বলা হবে না। দুপুর দুপুর গোটা ক্লাব হাউসে এটা রটে যায়। সিএবি কর্তারা বলতে থাকেন, ৩ জানুয়ারির পাকিস্তান ওয়ান ডে অবধি পিচের তদারকি একই হাতে থাকবে। তাতে দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে যাওয়া থামেনি। রাতে কেরল যাওয়ার পথে ফোনে উত্তেজিত বিষেন সিংহ বেদী বললেন, “কোনও বোর্ড প্রধানের এমন ন্যক্কারজনক মন্তব্য আমি আগে শুনিনি। টিম খেলতে পারছে না, আর দোষ হল কিনা যে পিচ করেছে তার। ছি ছি ছি!”
এ দিনের ইডেনে মিডিয়ার দেশীয় আর আন্তর্জাতিকযাবতীয় মাধ্যমে আলোচনায় বারবার উঠে এলেন দুই স্পিনার। প্রজ্ঞান ওঝার করা ৫০ ওভারে ব্যাটসম্যানদের একটুও বেগ দিতে না পারা দেখে বোলার বেদী। আর সেই তিনশো বলে একবারও রাউন্ড দ্য উইকেট না যাওয়া দেখে স্পিন উপদেষ্টা বেদী। রাহুল দ্রাবিড়ের মতো সুশীল টিভি বিশেষজ্ঞও বলে ফেললেন, “টিমের অন্তত কাউকে প্রজ্ঞানকে বলা উচিত ছিল। আর একটু বৈচিত্র তো আনবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নইলে কাজ হবে কী করে?”
আরও এক জন স্পিনারের নাম বারবার স্মরণ করা হল। ইডেন প্রেস বক্স থেকে তাঁকে টেক্সটও করলেন এক জন: কাম ব্যাক। |
প্রাপকের নিবাস বেঙ্গালুরু। নাম অনিল কুম্বলে।
সিরিজ জুড়ে রবিচন্দ্রন অশ্বিন যে বিরক্তি উৎপাদন করছেন, তাতে চার বছর আগে অবসর নেওয়া কুম্বলে এখনও ভাল ইডেনে। ইংল্যান্ডে মে মাসে প্রচণ্ড শীতে, বল গ্রিপ করা যাচ্ছে না, এমন ঠান্ডায় সিমিং পিচে বহির্দেশীয় স্পিনারদের যা বোলিং হিসেব দাঁড়াতে পারে, তাই দাঁড়িয়েছে উপমহাদেশ উইকেটে এক-এক জনের। অশ্বিন নাকি সিরিজের জন্য রহস্য বল তৈরি করেছেন! তা তিনি ১৮৩ রান দিয়ে কাতিয়েকুঁতিয়ে এক উইকেট নিলেন। আমদাবাদ থেকেই তাঁর এ রকম চলছে। অশ্বিনের বল এমনিতেই ঘোরে না। ভাগ্য ঘোরাচ্ছে নেহাত তামিলনাড়ুর বাসিন্দা বলে। নইলে চলতি সিরিজে উইকেটপিছু ৮৮ রান দিয়েও তিনি হরভজন সিংহকে কী করে বসিয়ে রাখেন?
অ্যালিস্টার কুকের ওই রকম রাজকীয় ইনিংস স্কুল ছাত্রসুলভ ভুলে সমাপ্ত না হলে ইংল্যান্ড আজই দুশোর বেশি ব্যবধান করে ফেলত। অবশ্য ক্যাপ্টেন কুক চলে গিয়েও রানের গতি কমেনি। সেশনপিছু প্রায় একশো করে তুলেছে ইংল্যান্ড। এক-এক সময় বোঝাই যাচ্ছিল না, হোম টিম কারা। ২৮ বছর পর ইংল্যান্ড এ দেশে পাঁচশোর বেশি রান করল। যা চলছে, ২৮ বছর পর সিরিজ জিতে ফিরলেও আশ্চর্য হওয়ার নেই।
জাহির খান হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে দু’বার ডেঞ্জার এন্ডে ঢুকে পড়ে দু’বারই সতর্কিত হলেন। জাহিরের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ম্যাচের এই অবস্থায় কেন সাবধানী হননি, তিনিই জানেন। তাঁর স্টাডের থেকে ফুটমার্কস তৈরি হওয়া মানে ওগুলো তো ক্লাব হাউস প্রান্ত থেকে বল করা গ্রেম সোয়ানের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে। অফ স্পিনারের জন্য আপনাই স্পট তৈরি হয়ে থাকবে। উলটো দিকে পানেসর। তিনি তো থাকছেনই ব্যাটসম্যানদের ওপর রহস্য, ধোঁয়াশা এবং মানসিক চাপসমেত। এখন তো ভারতের স্ট্র্যাটেজি হওয়া উচিত ছিল, নিজেদের কোনও বোলার কোনও ভাবেই উইকেটে ঢুকবে না। আমাদের ব্যাটসম্যানদের ড্র করানোর জন্য যত পারো উইকেট ভাল রাখো। তেমনই যত্নে যে ভাবে গোটা পাকিস্তান ফিল্ডিং সাইড রিভার্স সুইংয়ের জন্য বলকে তৈরি করত।
ভারত তা হলে হঠাৎ কালিদাস হতে যাচ্ছে কেন? উত্তর নেই। তিন দিনে পোড়খাওয়া আমরা অবশ্য জেনে গিয়েছিশ্রীনি-ধোনি কম্বিনেশনকে উটকো প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই।
|
ভারত প্রথম ইনিংস ৩১৬
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২১৬-১) |
কুক রান আউট ১৯০
ট্রট ক ধোনি বো ওঝা ৮৭
পিটারসেন এলবিডব্লিউ ওঝা ৫৪
বেল ক ধোনি বো ইশান্ত ৫
পটেল ক সহবাগ বো ওঝা ৩৩
প্রায়র ব্যাটিং ৪০
সোয়ান ব্যাটিং ২১
অতিরিক্ত ২২
মোট ৫০৯-৬
পতন: ৩৩৮, ৩৫৯, ৩৯৫, ৪২০, ৪৫৩।
বোলিং: জাহির ২৯-৬-৮২-০, ইশান্ত ২৯-৮-৭৮-১, অশ্বিন ৫২-৯-১৮৩-১,
ওঝা ৫০-১০-১৪০-৩, যুবরাজ ৩-১-৯-০। |
|
|