|
|
|
|
নাব্যতা হারিয়ে ভাণ্ডারদহ এখন স্তব্ধ ডোবা |
সেবাব্রত মুখোপাধ্যায় • বেলডাঙা |
প্রকৃতির খেয়াল এবং মানুষের সচেতনতার অভাব, দু’য়ে মিলে ক্রমশ হারিয়েই যাওয়ার মুখে ভাণ্ডারদহ বিল। এক সময়ে এই হ্রদ থেকেই সেচের জল পেতেন এলাকার কৃষিজীবীরা। এখন সেই জল পাওয়া তো দূরের কথা, বিলের বেশিরভাগ জায়গাতেই জল নেই। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, এই বিলের উপরে যে নৌকাঘাটগুলি ছিল, বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এক সময়ে ভাণ্ডারদহে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হত, এখন তা-ও হয় খুব ছোট একটি অংশে। আগে দুর্গাপ্রতিমা নৌকায় তুলে এই বিল ধরে অনেকটা এলাকা করা পরিক্রমা করার রীতি ছিল। তা আর এখন করা যায় না। যেটুকু অংশে জল রয়েছে, তা-ও সব সময়ে দেখতে পাওয়া শক্ত। বেশ লম্বা এই ভাণ্ডারদহ বিলের অনেকটা অংশই কচুরিপানায় ভর্তি। জলের অভাবে এই বিলে এখন মাছ চাষও করা যায় না সে ভাবে। পাট পচানোর জন্য জল পেতেও কৃষকদের সমস্যার শেষ নেই।
ভাণ্ডারদহ বিল ভাগীরথীর প্রায় সমান্তরাল হয়ে বয়ে গিয়েছে প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। বহরমপুর থানার পাঁচবেড়িয়া থেকে শুরু, বেলডাঙা থানার মানিকনগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এলাকার প্রবীণ মানুষদের অবশ্য দাবি, এই বিলের উৎস ছিল ভাগীরথীই। ভগবানগোলা এলাকার কোনও জায়গা থেকে এই বিল শুরু হয়েছিল। পরে অবশ্য সেই অংশটুকু বুজে গিয়েছে। সরকারি নথিতে এই বিলের এখন শুরু পাঁচবেড়িয়া থেকে। বহরমপুর থানার কুমড়োদহ ঘাটের কাছে ভাণ্ডারদহে জল রয়েছে। এই এলাকায় প্রায় ৩০ মিটার পর্যন্ত চওড়া ভাণ্ডারদহ। লালনগর ঘাটে নৌকা চলাচলও করে। এই এলাকাতেই এখনও নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়। হরিহরপাড়া নওদার কাছে এই বিল গিয়ে মিশেছে জলঙ্গিতে। |
|
কচুরিপানায় ঢাকা ভাণ্ডারদহ বিল। |
ভাণ্ডারদহ বিল নিয়ে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ায় এই বিলগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় যে জল মাটির নীচে জমা হয় কৃষিকাজে ব্যবহার হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে জল সঞ্চিত থাকার উপায় থাকে না।” ২০০৩-এর মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, ভাণ্ডারদহের কাছাকাছি আরও কয়েকটি বিল রয়েছে। তবে এই ক’বছরে সে সবও অবলুপ্ত প্রায়। মুর্শিদাবাদের দক্ষিণপ্রান্তে ভাগীরথী ছাড়াও এক সময়ে বেশ কয়েকটি নদী ও জলাশয় ছিল। যে কারণে, এই এলাকা ছিল অত্যন্ত উর্বর। ভাগীরথীর পশ্চিম দিকে কুয়ে, ময়ূরাক্ষী, কানা ময়ূরাক্ষী এবং দ্বারকা। পূর্ব দিকে জলঙ্গি ও ভৈরব বড় নদী। ছিল শিয়ালমারি নদীও। এখন তা প্রায় সবটাই মজে গিয়েছে। অথচ এই নদী বেরিয়েছিল পদ্মা থেকে, মিশেছিল জলঙ্গিতে। পদ্মা থেকে বেরিয়ে জলঙ্গিতে মিশেছে ভৈরব নদও। সেই নদেরও বেশ কিছু অংশ একেবারেই মজে গিয়েছে। ইসলামপুর থানা এলাকায় পদ্মার সঙ্গে যেখানে মিশছে ভৈরব, তা-ও বুজে গিয়েছে। ভৈরবে প্রত্যেক বছর ইসলামপুর, ভগীরথপুর, জিৎপুরে দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে জলপথে পরিক্রমা করা হত, নৌকা বাইচও হত। কিন্তু সে সব এ বছর নদীতে জল কম থাকায় হয়নি।
এক সময়ে এই এলাকায় ছোট বড় হ্রদ মিলিয়ে বেশ কয়েকটি জলাশয় ছিল। তার মধ্যে এখনও কিছুটা হলেও জল রয়েছে চাঁদের বিল, সুন্দরীয়া বিল আর ভাণ্ডারদহ। বোয়ালিয়া বিলটির অস্তিত্ব থাকলেও তেমন জল নেই। হরিহরপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের মধুসূদন ঘোষ বলেন, “বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। এই মরসুমে তো বৃষ্টি সে ভাবে হয়ইনি। যেটুকু জল রয়েছে, তা টেনে নেওয়া হচ্ছে চাষের কাজে। বাকি অংশটুকু ভরে যাচ্ছে কচুরিপানায়।” |
|
ভাণ্ডারদহের মানচিত্র। |
বেলডাঙা ২ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সহ সভাপতি তৃণমূলের সুনির্মল ঘোষালের কথায়, “শালমারি বিল, দাদপুর বিল, ওমরপুর বিল এখনও কোনওমতে টিকে রয়েছে। তবে মাছ চাষ ও সেচের জন্য জল টেনে নেওয়াই প্রধানত ক্ষতি করে দিচ্ছে।” বেলডাঙা ১ ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কংগ্রেসের সুখেন হালদারের বক্তব্য, “বেতবেড়িয়া থেকে মানিকনগর পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকায় সব থেকে বড় সমস্যা কচুরিপানা। এখানে নৌকা চলাচল করতে পারে না, মাছ চাষ হয় না। দৈনন্দিন কাজে যে জল লাগে, তা-ও সব সময়ে পাওয়া যায় না।” পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্লকে কৃষকদের সভায় বারবারই এই বিলগুলো বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন মধুসূদনবাবু ও সনির্মলবাবু। সরকার কী করছে? বেলডাঙা ১ বিডিও সঞ্জয় বিশ্বাসের বক্তব্য, “আ্রা অতীতেও বিল সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছি। এখন একশো দিনের কাজের মাধ্যমে এই বিল সংস্কার হবে।” শীতকালেই কাজ হতে পারে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। সুখেনবাবুর বক্তব্য, একশো দিনের কাজের মাধ্যমেই তাঁরা কচুরিপানা সরানোর কাজ করবেন।
কৃষক মনসুর আলির কথায়, “ভাণ্ডারদহের ধারে বাড়ি করেছিলেন পিতৃপুরুষেরা। ভেবেছিলেন, কোনও দিন চাষের জলের অভাব হবে না। এখন পাট পচানোর জলও পাই না।” স্থানীয় বাসিন্দা রাধানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক অনাদিকুমার মণ্ডল জানান, এক সময়ে এই সব বিল থেকে পাওয়া যেত পর্যাপ্ত ছোট মাছ। যেমন ছোট পুঁটি, সরপুঁটি, মাগুর, খোলসে, ছুলং, খয়রা, জিয়োল, চাঁদা মাছ। এখন সে সব মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গিয়েছে।
|
ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত। |
|
|
|
|
|