মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিলেন কিষাণগঞ্জের স্বয়ংবৃত গ্রামপ্রধানরা। তাঁহারা বুঝিয়াছেন, আধুনিক প্রযুক্তির ফলে আধিপত্যের রাজনীতি দূরবিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে। সমাজবদ্ধ মানবসভ্যতার উষাকালে ব্যাবিলনের রাজা হামুরাবি যে আইন করিয়াছিলেন, তাহাতে কোন নারী মুখ খোলা রাখিয়া রাস্তায় চলিতে পারে, আর কাহাকে মুখ ঢাকিয়া চলিতে হইবে, সে বিষয়ে নির্দেশ ছিল। বারবনিতার সহিত গৃহবধূর তফাত করিবার সেই তাগিদ হইতে তাহার পর যুগে যুগে নারীদের বশ্যতা নিশ্চিত করিতে অগণিত আইন হইয়াছে। তাহাও যথেষ্ট হয় নাই, তাই নারীকে গৃহবন্দি করিয়া, শিক্ষার আলো হইতে আড়াল করিয়া, অকালবিবাহ এবং অকালমাতৃত্বকে আবশ্যক করিয়া তাহার যৌনতাকে ‘সুরক্ষিত’ করিতে পুরুষরা কম পরিশ্রম করে নাই। পুরুষতন্ত্র বরাবরই এই সারসত্যটি বুঝিয়াছে যে, মেয়েদের চিন্তার স্বাধীনতা তাহাদের ‘সতী’ করিয়া রাখিবার প্রধান অন্তরায়। সুতরাং ধর্ম, নীতিশাস্ত্র, লোকাচার এবং আইন, নানা প্রতিপক্ষ খাড়া করিয়া মেয়েদের শরীর-মনের অবাধ যাতায়াত যথাসম্ভব সংকুচিত করা হইয়াছে। অতি সংকীর্ণ ‘নিরাপত্তার গণ্ডি’ রচনা করিয়া তাহার ভিতরের স্থানটুকু নির্দিষ্ট করা হইয়াছে ‘ভাল মেয়েদের’ জন্য। তাহা অতিক্রম করিলে কী হয়, তাহার প্রমাণ হিসাবে রামায়ণের নায়িকা সীতার উদাহরণটি অতিশয় কার্যকরী। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মহা সমস্যা দেখা দিয়াছে। মোবাইল ফোন এখন ঘরে ঘরে, তাহার মাধ্যমে বাহিরের যে কোনও পুরুষের সহিত ‘বাড়ির মেয়ের’ যোগাযোগ এখন সহজে নিবারণ করা সম্ভব নহে। ঘরের মধ্যে থাকিয়াই গণ্ডি লঙ্ঘন করিবার এমন উপায় স্বভাবতই পুরুষদের বিপন্ন করিয়াছে। আরও সমস্যা এই যে, এমন একটি আদেশ জারি করা যত সহজ, মেয়েদের উপর তাহা প্রয়োগ করা ততই কঠিন। যে ফোনের পরিচয়ই ‘চলমান’, তাহা কেবল ঘরে ব্যবহার করা হইল কি না, নিশ্চিত করিবে কে?
কিষাণগঞ্জের অভিভাবকগণ অনেক সমব্যথী খুঁজিয়া পাইবেন। যেমন চিনের প্রশাসন, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের শাসককুল। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সাহায্যে অধীনস্থের অবাধ্যতা যে সীমা ছাড়াইতেছে, তাহা ইহারা সকলেই হাড়ে হাড়ে অনুভব করিয়াছেন। তাই চিনে এখনও বিশেষ ওয়েবসাইটগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা রহিয়াছে। ‘আরব বসন্ত’ আনিবার মূলে যাঁহারা ছিলেন, তাঁহাদেরও অনেককে আটক করা হইয়াছিল ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করিবার কারণে। ভারতেও অবশ্য এমন নিদর্শনের অভাব নাই সমাজ-সংযোগের ওয়েবসাইটগুলিতে স্বাধীন মতামত জানাইয়া অনেকে পুলিশের খপ্পরে পড়িয়াছেন। স্বাধীন চিন্তা রুখিবার কত প্রয়াস! প্রশাসনের অভিভাবকত্ব চূড়ান্ত হইলে কিষাণগঞ্জের কিশোরীদের ন্যায় সকল নাগরিককেই মোবাইল ফেলিয়া ঘরে ঢুকিতে হইত। বিনা অনুমতিতে কাহারও সহিত কথা বলিলে, নিজের ইচ্ছামতো প্রার্থী (কিংবা পাত্র) নির্বাচন করিলে মোটা জরিমানা দিতে হইত। কিন্তু অবাধ্য কিশোরীরাই প্রমাণ করিয়াছে, জনতা অপ্রতিরোধ্য। বিশ্বের সকল মোবাইল ফোন সরাইলেও মনের কথা থামিবে না। |