ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উষ্ণতার আবহ এখনও বিরাজমান। তিস্তার জলবণ্টন ও ছিটমহল হস্তান্তর লইয়া দুই দেশের মতান্তর অব্যাহত থাকিলেও সেই উষ্ণতায় ঘাটতি নাই। প্রমাণ আগামী মাসে উভয় দেশের বন্দি-প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের নির্ঘণ্ট। এতদুপলক্ষে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের ঢাকা সফরসূচিও পাকা। ওই চুক্তির আগে-পরেই সম্ভবত বাংলাদেশের জেলে আটক আলফার প্রথম সারির সর্বশেষ নেতা অনুপ চেটিয়াকেও ভারতের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইবে। অবশ্য বন্দি-প্রত্যর্পণ চুক্তি না-থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সরকার আলফার অধিকাংশ নেতাকেই নয়াদিল্লির হাতে তুলিয়া দেন। অতঃপর তাঁহাদের সহিত ভারত সরকারের শান্তি-বৈঠক দফায়-দফায় অনুষ্ঠিত হইতেছে। অসম আজ বহুলাংশে জঙ্গি হামলামুক্ত। এ জন্য নয়াদিল্লি নিশ্চয় ঢাকার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতার একটি অভিব্যক্তি হইল, বাংলাদেশে অপরাধ করিয়া ভারতে আশ্রয় লওয়া সন্ত্রাসবাদী, জেহাদি বা চোরাচালানকারীদের একই তৎপরতায় নয়াদিল্লি ঢাকার হাতে সঁপিয়া দিতেছে।
সম্প্রতি এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও উন্নত হইয়াছে বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফরে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইতিপূর্বে বেগম জিয়া যখনই ভারত সফর করিয়াছেন, তাহা ছিল বাধ্যতামূলক, অনিচ্ছুক, নিষ্প্রাণ, শুষ্ক কূটনৈতিক সফর। এ বার কিন্তু বেগম জিয়ার সফরের কোনও বাধ্যতা ছিল না। নিছক সৌজন্য প্রদর্শন এবং ভারতীয় নেতা ও রাষ্ট্রনায়কদের সহিত শুভেচ্ছা-বিনিময়ই লক্ষ্য ছিল। বাংলাদেশে পার্লামেন্টের নির্বাচন আসন্ন। উপমহাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ‘ভারতবন্ধু’ এবং খালেদা ‘শত্রুভাবাপন্ন’ বলিয়া গণ্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদার বিএনপি দল সর্বদাই ভারতকে আগ্রাসী বৃহৎশক্তি রূপে শনাক্ত করে এবং হাসিনাকে সেই ভারতের ‘তাঁবে’ হওয়ার জন্য গালমন্দ করে। বিরোধী নেত্রী থাকাকালে খালেদার স্বতঃপ্রণোদিত ভারত-সফর তাই নিঃসন্দেহে তাঁহার দলকেও অন্য বার্তা দিবে। বস্তুত, বিএনপি-র তৃণমূল স্তরের সংগঠনে খালেদার ভারত-সফর রীতিমতো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিয়াছে। সম্ভবত খালেদা উপলব্ধি করিয়াছেন, রাজনীতিতে স্থায়ী মিত্র বা স্থায়ী শত্রু বলিয়া কিছু হয় না, কেবল স্থায়ী স্বার্থ হয়। খালেদার ভারত-অভিসার আবার হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামি লিগ দলে বিভ্রান্তি ছড়াইতেছে। তবে লক্ষণীয়, নয়াদিল্লি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসক বা বিরোধী, কোনও নেত্রীর প্রতিই পক্ষপাত দেখায় নাই।
বাংলাদেশের রাজনীতিকরাও বয়স ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে-সঙ্গে পরিণত ও পরিপক্ব হইতেছেন। প্রতিবেশী বা বিদেশি রাষ্ট্রের সহিত জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় লইয়া দরকষাকষি করিতে গেলে যে নিজেদের মতভেদ সরাইয়া রাখা উচিত, এত দিনে সেটা তাঁহাদের খেয়াল হইয়াছে। শাসক আওয়ামি লিগ, বিরোধী বিএনপি এবং হুসেন মহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি-সহ সব সংগঠনের প্রতিনিধি লইয়া গড়া একটি সর্বদলীয় গোষ্ঠী ভারতে আসিয়া বাংলাদেশের প্রাপ্য জল ও জমির ভাগ লইয়া দরাদরি করিতেছেন। এই ঐক্যও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরল ঘটনা, যাহা ভারতের পক্ষে ভবিষ্যতে কিছুটা অসুবিধাজনক প্রতিপন্ন হইতে পারে। বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ, সর্বসম্মত দাবির কাছে ভারতের দাবি বা আপত্তি ভাসিয়া যাইতে পারে। বিশেষত নদীর জলের ভাগ ও ছিটমহলের জমি ফেরত পাওয়ার দাবি। এই দুইটি দাবি পূরণের ক্ষেত্রেই প্রধান বাধা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের তীব্র আপত্তি। সীমান্তে গরু পাচার ও চোরাচালানকারীদের সহিত সংঘর্ষ, তাহাতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের জড়াইয়া পড়া এবং তজ্জনিত অনাবশ্যক প্রাণহানির ঘটনাগুলি এড়াইতেও রাজ্য সরকারের সহযোগিতা অত্যাবশ্যক। তবে তাহার জন্য ভারতীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা এবং জাতীয় স্বার্থের অন্তর্লীন দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তির দিকে অগ্রসর হওয়া দরকার। এই সমস্যা বাংলাদেশের নয়, ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা। কলিকাতার সহিত বসিয়া নয়াদিল্লিকেই তাহা মিটাইতে হইবে। |