সাতসকালেই এক শীর্ষ সিপিএম নেতা বললেন, “খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে ১৮৪ ধারায় ভোটাভুটি করতে চাওয়াটাই আমাদের একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেল।”
রাজ্যসভায় মায়াবতীর সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস যে এই ভোটযুদ্ধে জিততে চলেছে, সেটা জানতে তখন আর কারও বাকি নেই। ওই সিপিএম নেতা দুঃখ করে বললেন, “সংসদে যদি আমরা ভোটাভুটিহীন বিতর্ক করতাম (অর্থাৎ ১৯৩ ধারায় বিতর্ক), তা হলে গোটা দেশের মানুষের কাছে দেখিয়ে দিতে পারতাম, বেশি সংখ্যক দল ও বেশি সংখ্যক বক্তাই কিন্তু বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে। যাকে বলে সেন্স অফ দ্য হাউস।”
আজ দিল্লিতে সিপিএম পলিটব্যুরো বৈঠকও হয়েছে। সেখানেও বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিমান বসু কলকাতায় অনেক দিন আগেই এক বার বলেছিলেন, “১৮৪ ধারায় যদি না-ও হয়, সংসদে ১৯৩ ধারাতেও বিতর্ক হতে পারে।” কেন্দ্রীয় সরকারেরও প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল ১৯৩ ধারায় আলোচনা করার, যেখানে বিতর্ক-আলোচনা হত, ভোটাভুটি হত না। কিন্তু সিপিএম ও বিজেপি সাঁড়াশি আক্রমণে কংগ্রেসকে বাধ্য করেছে ১৮৪ ধারায় আলোচনা এবং ভোটাভুটিতে যেতে।
এখন ভোটে কংগ্রেস জিতে যাওয়ার পরে শুধু সিপিএম নয়, বিজেপি নেতারাও বুঝতে পারছেন, চালে ভুল হয়ে গেল। ময়না-তদন্ত করতে গিয়ে বিজেপি বুঝতে পারছে, কংগ্রেসকে মরিয়া হয়ে ভোটে জেতার জন্য উল্টে তারাই উদ্বুদ্ধ করেছে। আর তাই সুষমা স্বরাজকে সংসদে বলতে হচ্ছে, “ভোটে জেতাটা লক্ষ্য নয়। আমরা যুক্তি দিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য করতে চাই।” |
প্রশ্ন হল, তা-ই যদি হবে, তবে বিজেপি ভোটাভুটির দাবি করল কেন? সুষমা বলেছেন, “বেশি সংখ্যক দল ও বক্তা বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে। ভোটাভুটি যা-ই হোক, এই বিষয়টি স্পষ্ট।” এখানেই এখন প্রশ্ন তুলছেন সিপিএম ও বিজেপির অন্য নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, ১৯৩ ধারায় বিতর্ক হলেই হয়তো সুষমার যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হত।
মাঝখান থেকে এই জয়ের ফলে সরকারের মনোবল অনেক বেড়ে গেল। কংগ্রেস নেতা তথা সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কমল নাথ তো বলেই দিয়েছেন, “যো জিতা ওহি সিকন্দর।” কেন্দ্রে যে কোনও সরকার আড়াই বছর অতিবাহিত করলে তার আঁধার দশা শুরু হয়। শরিকরা সমর্থন প্রত্যাহার করে, ছোবল মারে। সেখানে দু’দফা মিলিয়ে ইউপিএ-র বয়স আট বছর ছাড়িয়েছে। দ্বিতীয় দফায় নতুন শরিক নিয়ে শুরু করেও সরকারকে বিভিন্ন সময়ে প্রবল চাপে থাকতে হয়েছে।
এমনই এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে যাওয়ার পরে নতুন রণকৌশল নিয়েছে সরকার। অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম ও বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা এক দিকে সংস্কারমুখী আদর্শের বিজয় কেতন ওড়াতে সক্রিয়। অন্য দিকে, কমল নাথ-রাজীব শুক্ল সংসদে কক্ষ সমন্বয়ে কৌশলী ভূমিকায়। মায়াবতীর সমর্থন আদায় এই পরিস্থিতিতে সামগ্রিক ভাবে কংগ্রেসের পালে বাতাস আনার পক্ষে যথেষ্ট। এনডিএ জমানায় এই কক্ষ সমন্বয়ের কাজটাই করতেন প্রমোদ মহাজন। এ ভাবে বিল পাশ করিয়ে বহু বার তিনি বাহবা পেয়েছেন। কমল নাথদের কক্ষ সমন্বয়ের কাছে পর্যুদস্ত হওয়ার পর বিজেপি নেতারা এখন নৈতিক জয়ের কথা বলছেন। কিন্তু তাকে উড়িয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা তথা কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেন, “হেরে গেলে বিজেপি ইমানুয়েল কান্টের নৈতিকতায় চলে যায়। আর জিতলে মেকিয়াভেলি।” |
এখন বিজেপি ও সিপিএম নেতারা বলছেন, গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে প্রচার করবেন। কিন্তু দু’টি দলেরই সাংগঠনিক সমস্যা প্রবল। গ্রামে প্রচার করতে গেলে সাংগঠনিক শক্তি লাগে। বিজেপি সংসদীয় দল এখন দলীয় সভাপতির পদ থেকে নিতিন গডকড়ীকে সরাতেই বেশি ব্যস্ত। এ দিকে গডকড়ী আজও বলেছেন, “আমি সৎ। আমি সরবো না।” তাই বিজেপির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, নেতৃত্বের সমস্যায় জেরবার দল কি পারবে গ্রামে গিয়ে প্রচার করতে? অনেক বিজেপি নেতারই বক্তব্য, “তা হলে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করাই ভাল ছিল। সংখ্যা ছিল না বলে সেই প্রস্তাব আমরা সমর্থন করিনি। অথচ ১৮৪ ধারায় ভোটাভুটি আছে জেনেও তা নিয়ে জোর করেছি।” তাঁরা মানছেন, “এটা উচিত হয়নি।” সমস্যা হল, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বে অন্তর্কলহ এত তীব্র যে, আত্মসমীক্ষার সুযোগও খুব কম। প্রথা অনুসারে, দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক তিন মাস অন্তর হওয়ার কথা। তা এখন আট মাস অন্তর হচ্ছে। কংগ্রেস বরং কখনও সুরজকুণ্ডে, কখনও জয়পুরে আত্মসমীক্ষায় বসছে।
জয়ের নতুন উদ্দীপনায় সরকার এখন চেষ্টা করবে কিছু অর্থ বিল পাশ করাতে। বিরোধী দলের ভূমিকা কী হবে সেটাই এখন দেখার। |