ভূতেদের ভবিষ্যৎ হিন্দি ছবিতে মোটেও উজ্জ্বল নয়। স্বয়ং আমির খান পাশে থাকলেও নয়! ‘তালাশ’ ছবিতে সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে গেল।
সম্ভাবনা অনেক রকমের। গভীর রাতে মুম্বইয়ের সি-ফেস রোডে দুর্ঘটনা, একটি গাড়ি রাস্তা থেকে ঝটিতি টার্ন নিয়ে সটান সমুদ্রে। চালকের আসনে ছিলেন মুম্বই ছবির নায়ক আরমান খান। ইন্সপেক্টর সুরজভান (আমির খান) তদন্তে নেমে জানতে পারেন, আরমান সে দিন নেশা করেননি। রাত দুটোয় স্টুডিও থেকে বেরিয়ে ড্রাইভার এবং সহকারীকে ছুটি দিয়ে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ওঁর রোজকার বাড়ি ফেরার পথে ওই রাস্তা পড়ে না। কিন্তু চেনা কাউকে দেখতে পেয়ে গাড়িটা তুমুল গতিতে সমুদ্রের দিকে ঘুরে গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তখন আদপেই কেউ রাস্তায় ছিল না!
টাইটেল কার্ডে ছোট ছোট শটের কোলাজে মধ্যরাতের সি-ফেস রোড, মুখে রং-মাখা যৌনকর্মী, গাড়ির জানলায় দরাদরি করতে আসা দালাল, লাল আলো জ্বলা সস্তার হোটেল, দূরে ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন। শুরুতেই তৈরি হয় জবরদস্ত থ্রিলারের সম্ভাবনা। চেনা ছকের মুম্বই নয়, বরং তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য মুম্বইকে দেখার সম্ভাবনা। |
সম্ভাবনাটা আরও বেড়ে যায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি পর্দায় আসার পর। যৌনকর্মীর সন্তান, লেংচে হাঁটে। লোককে ব্ল্যাকমেল করে। পকেটে মোবাইল, এ দিকে পুলিশকে বলে, ‘খেতে পাই না। ভিক্ষে করি স্যার।’
কত যে সম্ভাবনা! ছবিতে আমির ও রানির একমাত্র সন্তান দুর্ঘটনায় জলে ডুবে মারা যায়। তার পর থেকে রাতে আমির দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না। যদি সে দিন ছেলের খেলতে যাওয়াটা তিনি আটকাতে পারতেন? প্রিয়জনকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার পরই বিকল্প সম্ভাবনাগুলি মাথায় জমাট বাঁধে। ইস্, সে দিন যদি অন্য রকম ঘটত!
ছিল আরও এক সম্ভাবনা! তদন্তে নেমে আমির রোজি (করিনা কপূর) নামে এক যৌনকর্মীর সন্ধান পান। করিনা তাঁর সঙ্গে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে, তাঁকে সস্তার হোটেলে নিয়ে যায়, তদন্ত সমাধানে নানা ক্লু দেয়। শেষ দিকে জানা যায়, করিনাকে অন্য পুলিশরা কেউ দেখতে পায় না। রাতের হোটেলে আমির করিনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে লিফ্টে উঠছেন। কিন্তু সহকর্মীরা দেখে অন্য জিনিস। আমির আপন মনে বিড়বিড় করছেন। ততক্ষণে দর্শক জেনে গিয়েছেন, ছেলের মৃত্যুর পর ‘ডিপ্রেস্ড’ স্বামী ও স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কও নেই। তা হলে গোটাটাই অবচেতনার গতিবিধি নিয়ে থ্রিলার? করিনা কি আমিরের অবদমিত কামনার চিত্রকল্প?
কিন্তু এ সবের বাইরেও ছিল আরও কিছু ইঙ্গিত। ছবির শুরুতে ফাঁকা রাস্তায় আরমান কপূরের গাড়ি উল্কার মতো ছুটে যায়, কুকুর কেঁদে ওঠে। এমন কেউ আছে, যাকে মানুষ না দেখতে পেলেও মনুষ্যেতর প্রাণীরা অনুভব করতে পারে?
ইঙ্গিতগুলি তৈরি হয় মুহূর্তের ফ্রেমে। আমির-রানির একমাত্র ছেলে জলে ডুবে মারা গেলেও ছেলেটির বন্ধু বেঁচে যায়। এক দিন সিনেমা হলে রানি তাকে দেখতে পেয়ে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। আমির কড়া ভাষায় না করে দেন। ছেলেটি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে আমিরের দিকে। ওই চোখে কি সকলের অজান্তে ঢুকে এল কোনও মৃত শিশুর নীরব অভিমান? |
করিনাকে রাতের সি-ফেস রোড ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু আন্ডার-কনস্ট্রাকশন এক বাড়ির ছাদে রিভলভারের গুলি খেয়ে রক্তবমি করতে করতে নওয়াজ শেষ মুহূর্তে করিনাকে দেখে। ভয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে সে, তার পরই সটান নীচে।
এতগুলি সম্ভাবনা, কারণ রিমা কাগতির পরিচালনায় এই ‘আমির খান প্রোডাকশন’ চেনা ছকের বাইরে নতুন এক পরীক্ষার চেষ্টা করছিল। সাসপেন্স-থ্রিলার, অবদমিত মন আর অতৃপ্ত আত্মার সুপারন্যাচারাল গল্পের মিশ্রণ। ভূতের গল্প হতেই পারে। তাতে আপত্তি নেই। নিপাট বাস্তবতার ছকে থাকলে হলিউডে কোনও দিনই ‘এগজরসিস্ট’, ‘ওমেন’ বা ‘প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি’র মতো ছবি তৈরি হত না। বাংলায় বিভূতিভূষণ ‘দেবযান’ বা ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ লিখতে পারতেন না।
কিন্তু এই ছবির শেষে দেখা গেল, ভূত করিনা জলের নীচে আমিরের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। ‘হোয়াট লাইজ বিনিথ’ ছবিতে ‘ভূত’ মিশেল ফাইফার এ ভাবে হ্যারিসন ফোর্ডকে বাঁচিয়েছিলেন না? আমির এ বার ‘হলিউডমেব জয়তে’ টিভি-সিরিজ বানাতে পারেন!
পাওনার ঘরে দুই। নওয়াজউদ্দিন এবং আমির খানের অভিনয়! রানি মুখোপাধ্যায় এবং করিনা কপূর দুই নায়িকারই কিছু করার ছিল না। তবু রানি ক্লান্ত, অসুখী, বিষণ্ণ স্ত্রীর চরিত্রে মানিয়ে গিয়েছেন। আর করিনা? পালি হিলের অভিজাত উচ্চারণে কথা বলছেন সি-ফেস রোডের যৌনকর্মী!
আসলে প্ল্যানচেটে আসা ছেলে, করিনার ভূত, সবই সাবপ্লট। কোনওটাই পরস্পরের সঙ্গে মিশ খেল না। মৃৃত্যুর ও পার থেকে করিনা এসেছিলেন শুধুই তদন্তের ক্লু দিতে। ছবির শেষে, মাটির নীচে করিনার কঙ্কাল। আঙুলের হাড়ে আংটি। ওই আংটি পরে করিনাকে ফুল নিয়ে খেলা করতে দেখতেন আমির! ভূতেরা ফুলের গন্ধ শোঁকে?
এত সব দুর্বলতার কারণেই বেশি নম্বর দেওয়া গেল না। তবু নতুন এক্সপেরিমেন্টের সাহসকে কুর্নিশ জানাতে দশে ছয়। আমির, নওয়াজের অভিনয় এবং শর্মিষ্ঠা রায়ের আর্ট ডিরেকশন না থাকলে এই ষাট শতাংশ নম্বরও জুটত না।
সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু অধিক ভূতে গাজন নষ্ট! |