মেঘনাদ ছিলেন, রঘুপতি ছিলেন। হালে ওসামার বেশও নিয়েছিলেন। এ বার তিনি নারী। রবীন্দ্রনাথের ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’য় ক্ষীরো-র ভূমিকায় অভিনয় করছেন গৌতম হালদার।
সারা পৃথিবী জুড়েই বহু কাল থেকে নারীর ভূমিকায় পুরুষ এবং পুরুষের ভূমিকায় নারীর অভিনয়ের প্রচলন রয়েছে। নানা দেশের নানা লোকাচার, নানা উৎসব-পার্বণ-কার্নিভালে, নানা শিল্পকলায় নারী ও পুরুষের ভূমিকা পরিবর্তন একটা আবশ্যিক অঙ্গ। লিঙ্গভেদকে ছাড়িয়ে যাওয়াটা যে কোনও অভিনেতার কাছেই একটা চ্যালেঞ্জ এবং স্বপ্ন বলে মনে করেন গৌতম। মনে করেন, অভিনেতা মাত্রেই তার মধ্যে একটা দ্বৈত সত্তা থাকে। ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’য় এ বার সেই পরীক্ষাতেই বসতে চলেছেন তিনি নিজে।
কে বসেননি এই পরীক্ষায়? চার্লি চ্যাপলিন থেকে ডাস্টিন হফম্যান, জন ট্র্যাভোল্টা থেকে রবিন উইলিয়ামস...। ঘরের মাঠে কমল হাসান, আমির খান, গোবিন্দ থেকে রীতেশ দেশমুখ অবধি।
যদিও সবার পরীক্ষা এক রকম নয়। ডাস্টিন হফম্যান ‘টুটসি’-তে বা রবিন উইলিয়ামস ‘মিসেস ডাউটফায়ারে’ যে চরিত্র করেছেন, তারা আসলে পুরুষই। কিছু সময়ের জন্য মেয়ে সেজেছে মাত্র। অর্থাৎ গল্পের প্রয়োজনেই পুরুষ সেখানে কিছু ক্ষণের জন্য নারীর ছদ্মবেশ নিচ্ছে। তার পর একটা নির্দিষ্ট সময় কেটে গেলে বেরিয়ে পড়ছে তার আসল রূপ। এই রকম ভাবেই ‘মিসেস ডাউটফায়ার’ অবলম্বনে কমল হাসান করেছিলেন ‘চাচি ৪২০’। আমির-গোবিন্দ-রীতেশরাও বিভিন্ন ছবিতে নারীর ছদ্মবেশ নিয়েছেন। ঠিক যে ভাবে মিস ‘প্রিয়ংবদা’-য় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক যে ভাবে মহাভারতে অর্জুন বৃহন্নলার বেশে।
উল্টো দিকে পুরুষের বেশে নারীরও নানা আখ্যান আছে। মার্চেন্ট অফ ভেনিস থেকে চিরকুমার সভা উদাহরণ অনেক। সেখানে আবার গল্পের প্রয়োজনে নারী কিছু ক্ষণের জন্য পুরুষের বেশ ধারণ করছে। ব্রেশট-এর ‘গুড উওম্যান অফ সেজুয়ান’ অবলম্বনে ‘ভালমানুষ’ নাটকে কেয়া চক্রবর্তীর অভিনয় কলকাতার বহু দর্শকের স্মৃতিতেই এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। |
কিন্তু যেখানে পুরুষ আদ্যন্তই নারীর ভূমিকায় বা নারী আদ্যন্তই পুরুষের ভূমিকায়? যেখানে কোনও ছদ্মবেশের ব্যাপার নেই? ‘আ বিজি ডে’-তে চ্যাপলিন কিন্তু সেটাই করেছিলেন। এক দম্পতির গল্পে ঈর্ষাকাতর স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি। চ্যাপলিন একাও নন, সেই আমলে ওয়ালেস বিরি, ফ্যাটি আরবাকল, অ্যালেক গিনেস প্রমুখ অনেকেই নারী চরিত্রে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। পরের দিকে জেরি লিউইস, এডি মারফি, টেরি জোনস-এর মতো অনেককে নারী চরিত্রে দেখা গিয়েছে। ‘হেয়ারস্প্রে’ ছবিতে নারী চরিত্র করেই গোল্ডেন গ্লোব জেতেন জন ট্রাভোল্টা। হাবিব তনবীরের নির্দেশনায় ‘জিস লাহৌর নহী দেখা ওহ জামিয়া নহী’ নাটকে নারী চরিত্রে পুরুষের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতেন দর্শকরা। গৌতম মুখোপাধ্যায়ের ‘মা’ বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আবার ঠিক একই ভাবে ‘অরল্যান্ডো’ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে বিস্তর প্রশংসা কুড়িয়েছেন টিল্ডা সুইনটন। ‘আই অ্যাম নট দেয়ার’ ছবিতে বব ডিলানের ভূমিকায় কেট ব্ল্যানচেট অস্কার মনোনয়ন পেয়েছেন, গোল্ডেন গ্লোব জিতেছেন। এঁরা কেউই সাময়িক ভাবে পুরুষের চেহারা নেননি, পুরুষের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন।
বাংলায় একটা বড় সময় পর্যন্ত নারীর ভূমিকায় পুরুষের অভিনয়ই ছিল দস্তুর। কারণ, মেয়েরা তখন রঙ্গমঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করতেন না। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি বা অমৃতলাল বসুর মতো নটও প্রয়োজনে নারী চরিত্র করেছেন। সেই ধারার শেষের দিককার অন্যতম প্রতিনিধি চপল ভাদুড়ী এখনও মঞ্চাভিনয় ছাড়েননি। এ বার মঞ্চে প্রবেশ গৌতম হালদারের। একটি নাট্যোৎসবে প্রথম অভিনয় হয়ে গিয়েছে। আগামী রবিবার থেকে শহরে নিয়মিত অভিনয় হবে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’। সেখানে গৌতমের সঙ্গে আরও পাঁচ জন তরুণ মেয়েদের দলে ভিড়ে অভিনয় করবেন। এবং গৌতমও গল্পের প্রয়োজনে কিছু ক্ষণের জন্য মহিলার বেশ নিচ্ছেন না। মহিলার চরিত্রেই অভিনয় করছেন। গৌতম কি চান, মঞ্চে তাঁকে দেখে কেউ পুরুষ বলে চিনতেই না পারুক? গৌতমের স্বপ্ন সেটা নয়। সেই কারণে কণ্ঠস্বর বদলাচ্ছেন না তিনি। মিহি কণ্ঠস্বরের চমক দর্শকের নজর টেনে নিক, সেটা চাইছেনও না তিনি। তা হলে? “অভিনেতা হিসেবে নারীত্বের প্রতি আমার পর্যবেক্ষণ কতটা, সেটা দেখানোই আমার কাজ। তার জন্য গলা নয়, বাচনভঙ্গিটা আয়ত্ত করাই চ্যালেঞ্জ। দর্শক আমাকে পুরুষ জেনেই নাটকটা দেখবেন।” |