|
|
|
|
সুস্থ কিশোরীই দু’সপ্তাহ বন্দি মানসিক হাসপাতালে |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
সে মানসিক রোগী নয়। চিকিৎসকরা তা বুঝতেও পেরেছিলেন। তবু নয় নয় করে দু’সপ্তাহেরও বেশি তাকে কাটাতে হল লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। আর সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই বৃহস্পতিবার কলকাতা ছাড়ল রূপাল তিওয়ারি নামে ছত্তীসগঢ়ের এক কিশোরী।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা জানিয়েছেন, এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সরকারি হোম থেকে মানসিক ভাবে সুস্থ লোককে পাঠানো হয়েছে মানসিক হাসপাতালে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেও লাভ হয়নি।
রায়পুরে স্কুলের হস্টেল থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরছিল রূপাল। সহযাত্রীর দেওয়া মাদক মেশানো খাবার খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফেরার পরে দেখে সে হাওড়া স্টেশনে পুলিশের হেফাজতে। পুলিশ তাকে পাঠায় লিলুয়া হোম-এ। অচেনা পরিবেশে আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য কান্নাকাটি করলে হোম কর্তৃপক্ষ কোনও পরীক্ষা ছাড়াই তাকে মানসিক রোগীর তকমা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। সেখানেই এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের নজরে পড়ে সে। সেই সংস্থাই রূপালের বাড়িতে খবর দেয়। |
|
রূপাল তিওয়ারি |
কেন লিলুয়া হোম কোনও পরীক্ষা না করেই তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠাল? লিলুয়া হোমের সুপার করবী শীল এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর কথা বলার এক্তিয়ার নেই। তবে হোমের এক কর্তার কথায়, “মেয়েটা চেঁচাচ্ছিল। জানলার গরাদ ধরে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চিৎকার করছিল শুধু। আমরা কোনও ঝুঁকি নিইনি। পাগল তো, কখন কী করবে, কোনও বিশ্বাস নেই।”
অথচ লুম্বিনীর চিকিৎসকেরা স্পষ্ট বলেছেন, মানসিক রোগের কোনও লক্ষণ তাঁরা মেয়েটির মধ্যে পাননি। লুম্বিনীর সুপার জয়ন্ত মৈত্র জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলেছিলেন, মেয়েটি মানসিক ভাবে অসুস্থ এবং হিংস্র হয়ে পড়ছে। ওর চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “আমাদের ডাক্তাররা কিন্তু পরীক্ষা করে তেমন কিছুই পাননি। বাড়ি থেকে বহু দূরে সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে, অজানা লোকজনের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করলে যে কারও এমন প্রতিক্রিয়া ঘটা স্বাভাবিক, ওর ক্ষেত্রে শুধু সেটাই রয়েছে।” এক চিকিৎসকের কথায়, “এটুকু বোঝার জন্য ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন হয় না। যে কোনও মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষেরই এটা বোঝার কথা।”
তা হলে কেন যথাযথ পরীক্ষার ব্যবস্থা না করেই এমন পদক্ষেপ করা হল? জবাব মেলেনি। বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগজনক জানিয়ে এ বিষয়ে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র ।
প্রশ্ন হল, তা হলে হাসপাতালের তরফে ফোন করা হল না কেন? তা হলে কি ধরে নিতে হবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসকদের মধ্যে এমন মানবিক বোধ নেই? সুপার জয়ন্তবাবু বলেন, “ওই সংগঠনের কর্মীদের নজরে না পড়লে আমরাই হয়তো পরে ফোন করতাম। তবে স্বীকার করছি, আরও আগে উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল।”
রূপালের বাড়ি ছত্তীসগঢ়ের ডোনগড়গড়া গ্রামে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ১২ নভেম্বর বন্ধুদের সঙ্গে সে যখন ট্রেনে বাড়ি ফিরছিল, তখন এক সহযাত্রীর দেওয়া খাবার খায় সে। তার পর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে সে হাওড়া স্টেশনে নিজেকে পুলিশের হেফাজতে আবিষ্কার করে। পুলিশ ১৬ নভেম্বর তাকে লিলুয়া হোমে পাঠায় এবং হোম দিন দুয়েকের মধ্যে পুলিশের মারফত তাকে পাঠায় মানসিক হাসপাতালে।
রাজ্যের মানসিক হাসপাতালগুলিতে মনোরোগীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প চালায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেই কাজ করতে গিয়ে ওই সংগঠনের এক সদস্য রূপালকে খেয়াল করেন। রূপাল তাঁর কাছে কান্নাকাটি করে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানায়। নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বাড়িতে ফোন করার ব্যবস্থা করতেও আর্জি জানায়। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, “ওঁর মা-র সঙ্গে ফোনে কথা বলি। তিনি এসেছিলেন। কিন্তু কোনও পরিচয়পত্র আনেননি। তাই মেয়েটিকে ছাড়া যায়নি। উনি বাড়ি ফিরে পরিচয়পত্র নিয়ে ফের আসেন। বৃহস্পতিবার সরকারি নিয়ম মেনে ওর মা ওকে নিয়ে গিয়েছেন। একটা সহজ প্রক্রিয়া, কিন্তু তার জন্য এত সময় লাগল। আর এই গোটা সময়টা মেয়েটিকে মানসিক হাসপাতালে বন্দি থাকতে হল, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।”
রূপালের মা রেখা তিওয়ারি বলেন, “কলকাতা থেকে ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছি। মেয়েটাকে যে এ ভাবে মানসিক হাসপাতালে আটকে রাখা হবে, তা কল্পনাও করিনি। ও কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে তা ভেবে শিউরে উঠছি।”
কোনও সুস্থ মানুষ মনোরোগীদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হলে পরবর্তী সময়ে তার কী ক্ষতি হতে পারে?
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, “এই ভাবে জোর করে কোথাও থাকতে বাধ্য করা হলে ভিতরে এক ধরনের জেহাদ তৈরি হয়। এটা এমন ট্রমা, যা কিছু দিন থাকবে। ওকে সবর্দা নজরে রাখা দরকার। আদর-যত্নও প্রয়োজন, না হলে সমস্যাটি স্থায়ী হওয়ার ভয় থাকে। তবে ও যে হেতু শিশু নয়, তাই যত্ন নিলে এই ট্রমা পরবর্তীকালে কেটে যেতে পারে।” |
|
|
|
|
|