শাসনক্ষমতায় পালাবদলের পরে নিরাপত্তার নিরিখে গুরুত্ব কমেছে সিপিএম নেতাদের। উল্টো দিকে তৃণমূল নেতাদের নিরাপত্তার বহর বেড়েছে। এবং মাওবাদী প্রভাবিত জঙ্গলমহলের তিন জেলায় প্রশাসনিক সুরক্ষা-বিন্যাসে এ হেন ‘পরিবর্তন’ ঘিরে শুরু হয়েছে চাপান-উতোর। সিপিএম একে নতুন সরকারের সুপরিকল্পিত চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করলেও প্রশাসন তা মানতে নারাজ।
রাজ্য গোয়েন্দা-পুলিশ মনে করছে, সিপিএম যে হেতু আর শাসকদল নয়, তাই বর্তমানে সিপিএম নেতাদের উপরে মাওবাদী হামলার আশঙ্কা প্রায় নেই, অথবা থাকলেও আগের চেয়ে অনেক কম। এই মর্মে পাওয়া গোয়েন্দা-রিপোর্টের ভিত্তিতেই জঙ্গলমহলের তিন জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিএম নেতাদের অধিকাংশের নিরাপত্তারক্ষী সম্প্রতি প্রত্যাহার করেছে বা কমিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। পরিবর্তে ওই সব রক্ষীকে মোতায়েন করা হয়েছে তিন জেলার বিভিন্ন স্তরের কিছু তৃণমূল নেতার সুরক্ষায়।
জঙ্গলমহলে সিপিএমের তিন জেলা সম্পাদক অবশ্য এখনও সরকারি নিরাপত্তারক্ষী পাচ্ছেন। যদিও সিপিএম নেতৃত্বের মতে, এটা কার্যত ব্যতিক্রম। তাঁদের অভিযোগ, সার্বিক ভাবে জঙ্গলমহলে সিপিএম নেতাদের নিরাপত্তারক্ষী তুলে নেওয়াটা আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থের কৌশল। এর ফলে কেউ বিপন্ন হলে তাঁরা রাজ্য জুড়ে আন্দোলনে নামবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
জঙ্গলমহলে উল্লেখযোগ্য যে সব সিপিএম নেতার নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দলের প্রাক্তন পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক নকুল মাহাতো, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুরের জোনাল সদস্য তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শম্ভু মাণ্ডি, ঝাড়গ্রাম গ্রামীণ জোনাল কমিটির সম্পাদক রবি সরকার প্রমুখ। পুলিশ-সূত্রের খবর: নভেম্বরে ঝাড়গ্রাম পুলিশ স্থানীয় পাঁচ সিপিএম নেতার সব রক্ষী এক বারে তুলে নিয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিনপুরের যুব তৃণমূল নেতা জলধর পাণ্ডা পেয়েছেন দু’জন সরকারি রক্ষী। বাঁকুড়ায় রায়পুর লোকাল কমিটির সম্পাদক শঙ্কর পাত্র-সহ পাঁচ জনের রক্ষী রদ হয়েছে। সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র ও রানিবাঁধের বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রমের রক্ষীর সংখ্যা ছয় থেকে কমিয়ে দুই হয়েছে। অন্য দিকে বাঁকুড়া টাউনের তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তীর নিরাপত্তায় সম্প্রতি মোতায়েন হয়েছেন দু’জন ‘সিকিউরিটি।’ পুরুলিয়ায় সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণীন্দ্র গোপ বলেন, “আমাদের সাত নেতা আর রক্ষী পাচ্ছেন না। তালিকায় পার্টির প্রাক্তন জেলা সম্পাদক, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর দু’জন সদস্য ও এক জোনাল সম্পাদক আছেন।” তবে বলরামপুরের দুই তৃণমূল নেতা অঘোর হেমব্রম ও সৃষ্টিধর মাহাতোকে আট জন করে রক্ষী দেওয়া হয়েছে বলে মণীন্দ্রবাবুর দাবি।
এমন সিদ্ধান্ত কেন? রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহের ব্যাখ্যা, “কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপরে কোনও জঙ্গি সংগঠনের হামলার আশঙ্কা সব সময়ে এক রকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে তার হেরফের হতে পারে। হামলার আশঙ্কা কখন, কী রকম, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা (আইবি)-রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট নেতার নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে।” পুলিশ-সূত্রের খবর: যে আইবি-রিপোর্টের ভিত্তিতে জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তায় রদবদল হয়েছে বলে আইজি-র দাবি, তাতে বলা হয়েছে, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা এখন সিপিএম নয়, তৃণমূলকেই প্রধান শত্রু মনে করছে।
পুলিশ-কর্তার যুক্তি সিপিএম নেতৃত্ব মানতে নারাজ। বরং এর পিছনে তাঁরা চক্রান্ত দেখছেন। একই সঙ্গে ফের তুলেছেন তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাতের অভিযোগ। অমিয়বাবুর কথায়, “সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। আমাদের নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, অথচ তাঁদেরই রক্ষী তুলে নেওয়া হচ্ছে! আর যারা আক্রমণ করছে, তাদের সুরক্ষা জোরদার করা হচ্ছে! কিছু অঘটন ঘটলে প্রশাসনকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তেমন হলে রাজ্য জুড়ে আন্দোলনে নামব।” দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের মন্তব্য, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মমতা সরকারের যে পরিকল্পনা, এ তারই অঙ্গ। তৃণমূল ও মাওবাদীরা এখনও গোপনে মিলে কাজ করছে। তাদের হাতে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু ঠিক এই সময়েই আমাদের নেতা-কর্মীদের রক্ষী তুলে নেওয়া হল!”
তৃণমূল নেতৃত্বের কী বক্তব্য?
জঙ্গলমহলে তৃণমূলের শীর্ষ নেতা তথা রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা বলেন, “কার নিরাপত্তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, নতুন কাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে, সে সব কিছু জানা নেই। পুলিশই বলতে পারবে।” সুকুমারবাবুর দাবি, “জঙ্গলমহলে এখন মোটের উপর শান্তি রয়েছে। যেটুকু গণ্ডগোল, তা সিপিএম-ই করছে।”
সুরক্ষা-বন্দোবস্তে বৈষম্যের অভিযোগ মানে না পুলিশও। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “সাংসদ বা বিধায়ক নন, জঙ্গলমহলে এমন কিছু সিপিএম নেতার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিএম জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ডহরেশ্বর সেন ও তাঁর স্ত্রী নন্দরানি ডলের (প্রাক্তন মন্ত্রী) উদাহরণ দিচ্ছেন তাঁরা। “আবার লালগড় লোকাল কমিটির তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক জন রক্ষী ছিলেন। গত বছর সেপ্টেম্বর ইস্তক তাঁর দু’জন রক্ষী। ধরমপুর লোকাল কমিটির সম্পাদক বিনয় পাণ্ডে, সদস্য সুব্রত মাহাতো, বৈতা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুমন সিংহদেরও সরকারি নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন।” বলেন ওই পুলিশ-কর্তা।
এগুলোকেও অবশ্য ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে দেখছে সিপিএম।
|
সহ প্রতিবেদন: কিংশুক গুপ্ত |