ক্লাবহাউসের ওপর সেই বিরাট ছবিটা আর একবার মনে করিয়ে দিল। সেই রামও নেই। সেই অযোধ্যাও নেই।
তিনি ভিভিএস লক্ষ্মণ এখন বেঙ্গালুরুর এনসিএ-তে টেস্ট অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। তিনি রাহুল দ্রাবিড় এখন ইডেনেই আছেন, তবে কমেন্ট্রি বক্সে।
সে দিন প্রথম ইনিংসে ২৭৪ রানে পিছিয়ে ছিল ভারত। আজ এগিয়ে আছে ১০০ রানে। কিন্তু দুর্যোগের ঘনঘটায় স্টিভ ওয়-র অস্ট্রেলিয়া আর অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ডকে কোথাও যেন একই সুরে বেঁধে দিয়েছে। আর বেঁধে দিয়ে নীরবে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে, দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ জুড়ির মাধ্যমে মহানাটকীয় প্রত্যাবর্তন এগারো বছর আগে হয়েছিল বলেই এ মাঠে আবার ঘটবে তার কী মানে? |
চা-বিরতির পরের সেশনে নামার সময় টিম ইন্ডিয়াকে দেখলাম দড়ির কোণে দাঁড়িয়ে ছোট ‘হাডল’ করে নিতে। বোঝা গেল লাঞ্চের পরের সেশন যত অশুভই যাক, শেষ দু’ঘণ্টায় তাকে ঘুরিয়ে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকছে। গোটা মাঠ এবং ধোনিও নিশ্চয়ই তখন সেই আগন্তুকের প্রতীক্ষায়। যে আসবে আর সব কিছু ঠিক করে দিয়ে যাবে। বিশেষ এই অতিথি এসে পড়লেই হল। তার প্রকোপে একে একে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যাবে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের। অথচ ওই আসছে, সে আসছে করতে করতে সে আর দিনভর এলই না।
যে আগন্তুকের পানে এমন অধৈর্য প্রতীক্ষায় চাওয়া হয়েছিল তার নাম রিভার্স সুইং। জাহিরদের বল রিভার্স করল না গত কালের অ্যান্ডারসনের মতো। বহাল থেকে গেল অ্যালিস্টার কুক-রাজই। মোতেরায় যে রাজবংশ শুরু হয়েছে ১৮ নভেম্বর থেকে।
মাত্র সাতাশ বছর বয়সে ব্যাটসম্যান ও ইংল্যান্ড অধিনায়ক হিসেবে কুক নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে পুরনো ইতিহাসের বই খুলতে বাধ্য হচ্ছে নবীন ব্রিটিশ সাংবাদিক। অনিবার্য তুলনায় চলে আসছে ওয়াল্টার হ্যামন্ডের মতো প্রবাদপুরুষের নামও। অধিনায়কত্বে যে ভুলগুলো পূর্বসুরি অ্যান্ড্রু স্ট্রস করতেনই না এবং তিনি কুক করছেন, সেগুলো বেমালুম ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সিরিজে তিন টেস্টে তিনটে সেঞ্চুরি হয়ে গেল কুকের। আর অধিনায়ক হিসেবে টানা পাঁচ টেস্টে সেঞ্চুরি। বিশ্বরেকর্ড অতি অবশ্যই। আর ব্যাটিং দেখে মনেই হচ্ছে না লোকটা অভিবাসন দফতর পেরিয়ে বিদেশ থেকে এসেছে। বরং মনে হবে,এ নিশ্চয়ই সদর স্ট্রিট এলাকা-টেলাকায় থাকে। কোনও মার্কেন্টাইল কোম্পানিতে চাকরি করে। সিসিএফসি-র বারে রাত্তিরে পাওয়া যায়। জিজ্ঞেস করলে এখনই প্যান কার্ড নম্বর বলে দেবে। লুচি-আলুভাজার সঙ্গে দিব্য পরিচিত। |
কুক আর কম্পটন যখন ভারতীয় বোলিংকে ইংরেজদের প্রিয় ভারতীয় খাদ্য তন্দুরি চিকেনের মতো চিবোচ্ছেন, তখন অনামী ক্রিকেটপ্রেমীর টুইট দেখলাম। ‘ডানকান ফ্লেচার সফরে স্পিন খেলার ব্যবস্থা রাখেননি না ইংল্যান্ডের জন্য। তাই ওরা মাঠে বেশি করে স্পিন খেলে খিদে মেটাচ্ছে।’ শুধু তো স্পিন খেলা নয়। সরল করে খেলা। বিষ্যুদবার ইংরেজ ব্যাটসম্যানদের নাগাড়ে প্যাডল সুইপ খেলতে দেখে মনে হচ্ছিল, ভারতের জন্য এদেরও কি বব উলমার মডেলে তৈরি করা হয়েছে? উলমার ভারতে ওয়ান ডে টিম নিয়ে আসার আগে বলেছিলেন, “সুইপ খেলতেই হবে ও দেশে। ওয়ান ডে-তে আরও বেশি। তাই আমার টিমের এগারো নম্বর অ্যালান ডোনাল্ডকেও রিভার্স সুইপ খেলানো অভ্যেস করানো রয়েছে।” ক্যাপ্টেন কুকের ব্যক্তিগত স্পিন-ধ্বংসকারী জাহাজ তো না হয় বোঝা গেল। বাকিরা এত ভাল প্যাডল সুইপ খেলছে কী করে? শুনলাম, দুবাইয়ে টিমের কন্ডিশনিং ক্যাম্পে কোচ অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার আর ব্যাটিং কোচ গ্রাহাম গুচ সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন সুইপ খেলানোর ওপর। এঁরা দু’জন সুইপে পরিমার্জনের জন্য বিশেষ খ্যাতনামাও বটে।
মুখুজ্জ্যেবাবুর পিচ এখন অনেক ভাল ব্যবহার করছে। বল পড়ে খুব দ্রুতগতিতে আসছে না। সুইপে ঝুঁকি কম। তবু নিক কম্পটনের মতো মন্থর স্ট্রোকখেলিয়েও যখন-তখন মারছেন কী করে? হতেই পারে কোচ নির্দিষ্ট সুইপ অনুশীলন তার রেসিপি। নইলে নিক যে কম্পটন বংশের মানুষ খেলা দেখে বোঝার ন্যূনতম উপায় নেই। ঠাকুর্দা ডেনিসের ব্যাটিং দেখে কার্ডাস লিখেছিলেন, ‘মানুষটার বৈশিষ্ট্য হল ওঁর খেলার বিনোদন সরবরাহে কোনও রেশন নেই।’ আর নাতি কম্পটনের ক্রিকেট হল দর্শকের হাতে রেশনকার্ড ধরিয়ে দেওয়া। তোমার হাতে দু’টো কার্ড মানে এতটা গম, এতটা চাল, এর বেশি নয়। রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিকেট দেখার মধ্যে এমনিতেই একটা বিরক্তি আছে। দ্বিতীয় দিন সেই বিরক্তির ফাইলে একটা অ্যাটাচমেন্ট করে দিয়েছিল ধোনির ভারত। নিজেদের ফিল্ডিং সাজানো আর বোলিং। |
ইডেনে এ বার অনেক কিছুই প্রথমবার ঘটছে। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন করে এক জন ফিল্ডার এক ওভারে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ। পরের ওভারে স্লিপে ফিল্ডিং করলেন। টানা কয়েক ওভার সেটা চললও। বেনিফিট ম্যাচেও এমন আশ্চর্যজনক কিছু কখনও ঘটেছে কি না সন্দেহ! স্লিপ আর ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ সম্পূর্ণ দু’ধরনের ক্লোজ ইন ক্যাচিং প্রস্তুতি দাবি করে। ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে অনেক নীচু হয়ে দাঁড়াতে হয়। যেখানে ফিল্ডার প্রায় পদ্মাসন করার কাছাকাছি উচ্চতায় নেমে যায়। সে শুধু রিফ্লেক্সে বল ফলো করে। বোলার দেখে না। ব্যাটসম্যানের স্ট্রোক খেলা দেখে না। স্লিপ ঠিক উল্টো। স্লিপ ফিল্ডারের আদর্শ পজিশনিং সম্পর্কে বলা হয়, পাশে দাঁড়ানো তোমার বন্ধুর পকেট থেকে রুমাল পড়ে গিয়েছে। তুমি তুলে দিতে যাচ্ছ। কোমরটা ঠিক যে হাইটে নেমেছে ওটাই তোমার আদর্শ স্টান্স। স্লিপ ঠিক উইকেটকিপারের মতোই পুরো বলের মুভমেন্ট দেখার সুযোগ পায়। আজহারউদ্দিনের মতো কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা দু’টো জায়গাতেই দারুণ। কিন্তু সেটা তো মহাব্যতিক্রম! এ দিন চেতেশ্বর পূজারাকে স্পিনারের জন্য এক ওভার ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, পরের ওভার পেসারের জন্য স্লিপে পাঠানো হচ্ছিল। পরিবর্ত হিসেবে যিনি ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করেন সেই অজিঙ্ক রাহানেকে যেহেতু রঞ্জি খেলার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, পূজারাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। প্রকৃতিগত ভাবে দু’টো জায়গার মধ্যে ঠিক ততটাই মিল, যতটা মিল সিপিএম আর তৃণমূলে। তাই গাঁটছড়ায় ঠিক অনিবার্য ব্যাপারটাই ঘটল। স্লিপে সহজতম ক্যাচ পড়ে গেল পূজারার হাত থেকে। কুক তখন মাত্র ১৭। চলতি সিরিজে কুকের যা ফর্ম তাঁর সহজ ক্যাচ ছাড়া মানে নতুন কেনা বিমএমডব্লিউ-কে ধাপার মাঠে ঢুকিয়ে দেওয়া। ইংল্যান্ডের মাঠে হার্শেল গিবসকে বলেছিলেন স্টিভ ওয়, ‘ওহে আমায় ফেলে তো তুমি ম্যাচটাই ফেলে দিলে।’
|
ভারত প্রথম ইনিংস
(আগের দিন ২৭৩-৭) |
ধোনি ক সোয়ান বো ফিন ৫২
জাহির এলবিডব্লিউ পানেসর ৬
ইশান্ত বো পানেসর ০
প্রজ্ঞান ন:আ: ০
অতিরিক্ত ২৪
মোট ৩১৬
পতন: ৪৭, ৮৮, ১১৭, ১৩৬, ২১৫, ২৩০, ৩৬৮, ২৯২, ২৯৬, ৩১৬।
বোলিং: অ্যান্ডারসন ২৮-৭-৮৯-৩, ফিন ২১-২-৭৩-১,
পানেসর ৪০-১৩-৯০-৪, সোয়ান ১৬-৩-৪৬-১। |
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস |
কুক ব্যাটিং ১৩৬
কম্পটন এলবিডব্লিউ ওঝা ৫৭
ট্রট ব্যাটিং ২১
অতিরিক্ত ২
মোট ২১৬-১
পতন: ১৬৫।
বোলিং: জাহির ১৬-৪-৪৮-০, ইশান্ত ১৫-৬-৩৫-০,
অশ্বিন ২৩-৪-৬৮-০, ওঝা ১৯-৪-৬৫-১। |
|
|