নুরুল আবসার • উলুবেড়িয়া |
প্রকাশ্যে চোলাই মদ বিক্রি করবেন, ঠিক করেছেন সন্ন হাজরা। চোলাই মদ খেয়ে মারা গিয়েছেন তাঁর দিনমজুর স্বামী, এখন ছেলেও চোলাই ধরেছে। উলুবেড়িয়ার তুলসিবেড়িয়া গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে চোলাই বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সন্ন, বহুবার ভেঙে দিয়েছেন চোলাইয়ের ঠেক। তারপরেও বাজারপাড়ায় তাঁর চোখের সামনে চোলাই বিক্রি হতে দেখে আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না। বললেন, “স্বামী হারিয়েছি। ছেলের সর্বনাশ দেখতে রাজি নই। এ বারে আমি সবার সামনে চোলাই বিক্রি করব।”
উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের নির্মল মাজিও মেনে নিয়েছেন চোলাইয়ের রমরমা। তিনি বলেন, “চিকিৎসক হিসাবে বলতে পারি চোলাই মদের বিষক্রিয়া এই গ্রামের কতটা ক্ষতি করেছে। আমি নিজে মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে ঠেক ভেঙে দিয়েছি। অশান্তিও হয়েছে। র্যাফ নামাতে হয়েছে।” গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তাররাও অস্বাভাবিক চড়া হারে লিভারের অসুখের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। |
গত কয়েক বছর ধরে এই এলাকায় শতাধিক মহিলা বিধবা হয়েছেন চোলাই মদের কারণে, বলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার মন্টু শী। তিনি বলেন, “ঠেক তুলে দেওয়ার জন্য আন্দোলনে রয়েছেন এমন বহু বিধবা যাঁদের স্বামীরা চোলাই মদ খেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন।” আন্দোলনের নেত্রী কল্যাণী পালুই, মল্লিকা চৌধুরীদের অভিযোগ, “আমরা ঠেকগুলিতে হানা দিলেও পঞ্চায়েতের মাথাদের একাংশ তাদের রক্ষা করেন।” চোলাইয়ের রমরমা উলুবেড়িয়ার তুলসিবেড়িয়া গ্রামের গরিব মানুষগুলির ঘরে ঘরে অকালমৃত্যুর আতঙ্ক তৈরি করেছে। মৃতের তালিকায় রয়েছেন যুবক থেকে বৃদ্ধ, সকলেই।
এমনকী একই পরিবারের একাধিক সদস্য নেশাসক্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। বাস স্ট্যান্ডের কাছে থাকতেন ছোট ব্যবসায়ী জওহর দলুই। বছর পঁয়তাল্লিশের জওহরবাবুর মৃত্যু হয়েছে এ বছর পুজোর ক’দিন আগে। তাঁর স্ত্রী লীনাদেবী বললেন, “আমার স্বামীর চোলাইয়ের নেশা ছিল। লিভার পচে যায়। চিকিৎসকেরা মদ খেতে বারণ করলেও তিনি শোনেননি।” জওহরবাবুর ভাই অষ্ট দলুইয়ের মৃত্যু হয় তার মাত্র কয়েক দিন আগে। লীনাদেবী বলেন, “আমার দেওরও চোলাইয়ের নেশা করতেন। লিভারের অসুখে ভুগেই মারা যান।”
বছর বাইশের যুবতী আশা পোড়েল স্বামীকে খুইয়ে মাস ছয় হল ফিরেছেন বাপের বাড়ি। তাঁর স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি সুব্রত পোড়েল (২৮) লিভারের অসুখ হলেও ডাক্তারের নিষেধ শোনেননি। পেশায় গাড়ির খালাসি বাজারপাড়ার বাসিন্দা জয়দেব হাজরা মারা গিয়েছেন তিন বছর আগে। স্ত্রী সুমিত্রা বললেন, “চোলাই খেতে বারণ করলে আমার স্বামী আমাকেই মারধর করতেন। বমি আর পেটের যন্ত্রণা হতে থাকল। ডাক্তার দেখানো হলেও কিছু করা যায়নি।” শিবতলা পাড়ার সবিতা রায়ের স্বামী গোবর্ধন মারা গিয়েছেন একই ভাবে। এমন উদাহরণ রয়েছে শিবতলাপাড়া, বাজারপাড়া, বাসস্ট্যান্ড, ঢাকিপড়া প্রভৃতি এলাকায়।
তুলসিবেড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক শেখ তাজউদ্দিন বলেন, “মাসে অন্তত ছয় জন নতুন রোগী আসেন লিভারজনিত পুরোন (ক্রনিক) রোগের চিকিৎসা করাতে। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা তার থেকে অনেক বেশি। আমরা চোলাই খেতে বারণ করি বলে প্রথমে অনেকে এখানে আসেন না। যাঁরা আসেন তাঁদের প্রায় শেষ অবস্থা।”
তুলসিবেড়িয়া পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের মদন মণ্ডল বলেন, “এক সময়ে এখানে চোলাই মদের ঠেক চলত। বহু মানুষ মারাও গিয়েছেন।” তবে তাঁর দাবি, তাঁদের তৎপরতারয় গ্রামে চোলাইয়ের ঠেক এখন নেই বললেই চলে। বাইরে থেকে চোলাই এনে বিক্রি হয়। ঠেক তুলে দিতে মহিলাদের আন্দোলন তিনি অবশ্য সমর্থন করেন না। “কারও বাড়ি অযথা হানা দেওয়া ঠিক নয়,” বলেন তিনি। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, উলুবেড়িয়া ২ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের এক মহিলা সদস্যের বাড়িতেই চলছে চোলাইয়ের ঠেক। মদনবাবুর সাফাই, “ওই মহিলা সদস্য নিজে এই ব্যবসা করেন না। তাঁর শ্বশুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।” নির্মলবাবু বলেন, “আমিও শুনেছি পঞ্চায়েতের এক মহিলা সদস্যের বাড়িতে চোলাই মদের ব্যবসা চলে। আমি খোঁজ নেব।” এক দিকে পঞ্চায়েত-প্রশাসনই অবাধে চোলাই বিক্রিতে মদত দিচ্ছে, অন্য দিকে চোখের সামনে স্বামী, ছেলেদের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে বিক্ষুব্ধ সন্ন, কল্যানী, মল্লিকারা। উলুবেড়িয়ার এসডিপিও শ্যামলকুমার সামন্ত অবশ্য মেয়েদেরই সতর্ক করে বলেছেন, “কেউ যেন নিজের হাতে আইন তুলে না-নেন।” |